Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

তোমার মনের অস্বস্তির কোন হেতু খুঁজিয়া পাইলাম না ৷ তুমি স্বাধীন স্বতন্ত্র ৷ তোমার যেমন রুচি, যেমন প্রকৃতি, যেমন অবস্থা তুমি তেমনই চলিবে ৷ অন্যেরা যদি খুশি না হন, তা তাঁরা বুঝুন ; যদি তোমার সঙ্গে না পোষায়, সরে পড়ুন ৷ পাড়ার লোককে খুশি করিবার জন্য কেউ জন্মায় না — সবাই স্বাধীন, নিজের সখে নিজের পথে সবাই চলে, পরের মুখ চেয়ে কে চলে বল ! তুমি ‘খামকা’ ঐ তুচ্ছ বিষয় ভাবিয়া মন খারাপ করো না ৷

এখানে একটি লোক আছে ; সে বিলাপী ও বিষাদী ছিল ৷ অর্থাৎ তার ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য সর্বদা বিষণ্ণ থাকিত ও বিলাপ করিত ৷ তাহাকে আমি সদাই বলিতাম, “তুমি আপন মনে চল ; তুমি যা পার যেটুকু পার তাতেই খুশি থাক ৷” বলিতে বলিতে তার বিষাদ দূর হইয়াছে ৷ তুমি কেন যে মন খারাপ কর বুঝি না ৷ “ভাল হতো আরও ভাল হলে ?” আমি তো তোমার মতো ভাল লোক আর কাহাকেও দেখি না, তোমার কোথায়ও খুঁত খুঁজিয়া পাই না ৷ ওহে মানুষ তো দেবতা নহে ৷ আমরা মানুষকে মানুষরূপেই ভালবাসি তার শত দোষ-ত্রুটি সহ ৷

ঐ যে ঠাকুর ঘরে যাওয়া, ধ্যান করা, ঐ যে স্বামীজীর বই পড়া, গীতা মুখস্থ করা ওসব নিয়ে তুমি একটুও ভাবিও না ৷ সময় হলে হবে ৷ যদি ও-সব নাই বা হয় তাতে ক্ষতিটা কী ? কয়টা লোকে ওসব করে ? আমরা সন্ন্যাসীরাই করি না ৷ আর তুমি তো কচি খোকা ৷

তুমি মন হইতে সকল দুঃখ বেদনা দূর করিয়া প্রসন্ন হও ৷ সব তাতে হাসিতে শিখ ৷ আমেরিকাতে এক ধর্ম সম্প্রদায় আছে ; তারা habit of happiness অভ্যাস করে ৷ তারা সব অবস্থাকে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করে ৷ ধর্ম সাধনার মূল ঐ তিতিক্ষা — সকল দুঃখ প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করা ৷ “সহনং সর্বদুঃখানাম্ অপ্রতিকারপূর্বকং চিন্তাবিলাপরহিতং” — হও ৷ তোমার মুখে সর্বদা হাসি দেখিব ৷ মুখ ভার করা একেবারেই খারাপ ৷

পূর্বে ছিল, ‘ব্রাহ্মণ সেবা’, ‘সাধু সেবা’ এখন ‘জীব সেবা’ ৷ “সর্ব জীবের ভিতরে শিব আছেন” জেনে সকলকে আমরা সেবা করি ৷ কারণ গীতা বলেন, “সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে” — সাধু ও পাপীকে সমান দেখাই প্রকৃত দেখা ৷ কে সাধু আর কে অসাধু, আমার জানবার দরকার নাই ৷ আমি জানি — “ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে-অর্জুন তিষ্ঠতি ৷” হরি হরি বল ৷

Prabrajika Mokshya Prana Mataji s spiritual Msj

প্রব্রাজিকা মোক্ষপ্রাণা মাতাজীর পত্রের কিছু অংশ :~
~~~~~~~~

জীবনের অমূল্য সময় হেলায় ফেলায় কাটিয়ে দিলে শেষে হাহাকার করা ছাড়া কিছু থাকে না ৷ আমি তোমাকে একটা রুটিন করে দিচ্ছি ৷ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়ে তা যদি তুমি যথাযথ পালন কর তাহলে জীবনে শান্তি ও আনন্দ অবশ্যই পাবে ৷

সূর্যোদয়ের আগে উঠবে ৷ উঠে ছাদে গিয়ে পায়চারি করবে ৷ সূর্যোদয় হলে সূর্যপ্রণাম করে নিচে আসবে ৷ এসে মুখ, হাত, পা ধুয়ে বস্ত্র পরিবর্তন করে নিজের আসনে বসে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করবে এবং তোমাকে যে মন্ত্র দিয়েছি সেই মন্ত্র জপ করবে ৷

জপ করার পর প্রথম প্রথম অন্তত আধ ঘণ্টা ধ্যান করবে ৷ ছবির দিকে বা মূর্তির দিকে তাকিয়েই ধ্যান করবে ৷ তারপর উঠে চা-জলখাবার খেয়ে কথামৃত ও গীতাপাঠ করবে একঘন্টা ধরে ৷ তখন অন্য কোনও বিষয়ে কথাবার্তা বলবে না ৷

তারপর স্নান সেরে নেবে বা বাজারে যাবে ৷ বাজারে গিয়ে দোকান-বাজার করবে ৷ পথে মানুষের মাঝে খানিকক্ষণ বেরিয়ে আসবে ৷ বাজার থেকে ফিরে এসে ভালো করে স্নানাদি সেরে আবার জপ করতে বসবে ৷ এক ঘন্টা জপ করবে ৷

তারপর উঠে কাগজ-টাগজ পড়বে বা বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে ৷ তখন সামান্য কিছু আহার বা একটু চা খেতে পার ৷ তারপর তোমার যা পুস্তকাদি পড়তে ইচ্ছে করে তা পড়ো বা বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলো ৷ তারপর ভাত খেয়ে উঠে বিশ্রামের পর আবার কাপড় ছেড়ে জপ ( এক ঘণ্টার বেশি নয় ) করবে ৷

বিকেল চারটে বাজলে চা খাবে ৷ তারপর অন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে পার বা অন্যদের সঙ্গে কোনও সদগ্রন্থ পড়তে পার বা ঘন্টাখানেক রাস্তায় পায়চারি করে আসতে পার ৷ তারপর হাত-পা ধুয়ে অন্তত দু ঘণ্টা আসনে বসে জপ করবে ৷

ভালো লাগুক বা না লাগুক ওষুধ গেলার মতো এই রুটিন অনুসরণ যদি ঠিকমতো কর তাহলে জীবন অন্য খাতে বইবে ৷ তুমি এই রুটিন অন্তত চার-ছয় মাস অনুসরণ করো ৷ পরীক্ষার্থী ছাত্র যেমন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করে তার মনোমতো যোগ্য ফল লাভ করে, আধ্যাত্মিক পথেও জানবে ঠিক তাই-ই আছে ৷ চেষ্টা না করলে কেউ কিছু করে উঠতে পারবে না ৷ আধ্যাত্মিক পথ খুব কঠিন ৷ ওই কষ্টের পথকে যে সানন্দে নিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করে, সে ঠিকই পরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয় ৷

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

সৃষ্টির প্রথমে একটা ‘কথা’ বা একটা ‘শব্দ’ ছিল তা-ই বেড়ে বেড়ে এমন সংখ্যাতীত শব্দ ৷

আমরা অল্প অল্প শিখেছি আর সামনে আছে বহু ৷

তবে ঐ মূল শব্দটা, না শিখলে, শিক্ষা শেষ হয় না, কারণ মূল একটা, তা শিখা যায় ; কিন্তু, তার বিকাশ অনন্ত ; কাজেই শিক্ষারও অন্ত হয় না ৷

সেই একটিতে যেতে অনেক কথা দরকার হয় ৷ তাই আমিও বকছি, তুমিও শুনছ ৷

শেষে দাঁড়াবে একটা কথা ৷ তখন তুমিও চুপ আমিও চুপ ৷

এখন বলা ও শোনাতে খুব আনন্দ ৷ তখন, না বলা, না শোনাতে হবে চূড়ান্ত আনন্দ ৷

সুখমাত্যন্তিকং যৎতদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যম্ অতীন্দ্রিয়ম্ ৷

( স্বামী প্রভানন্দজীকে লিখিত )

Prabrajika Mokshya Prana Mataji s spiritual Msj

🌟ঠাকুর, মা সবাই এখানে রয়েছেন কিন্তু আমরা তা স্থূলচোখে দেখতে পারছি না ৷ কিন্তু তাঁরা আছেন ৷ কারণ — ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্ ‘৷

🌟গভীরভাবে জপ করলে চেতনাশক্তি জাগ্রত হয় ৷

🌟চেতনাশক্তি জাগ্রত হলে তা আমাদের ইষ্টবস্তুর দিকে নিয়ে যায় ৷

🌟ঠাকুর বলতেন, ‘এই বেড়ালই বনে গেলে বনবেড়াল হয় ৷’ অর্থাৎ এই মনকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে ৷

🌟শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি ও শুদ্ধ আত্মা এক ৷ মন শুদ্ধ পবিত্র হলেই তা ইষ্টবস্তুর সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে ৷

🌟তাই ঠাকুর বলতেন, মনই গুরু হয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে ৷

🌟আধ্যাত্মিক পথে যখন পা দিয়েছ তখন একটা দৃঢ়সঙ্কল্প থাকা চাই, কিছু না পেয়ে যাবে না ৷

                — প্রব্রাজিকা মোক্ষপ্রাণা মাতাজী ৷

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

জীবন সকলের নিকটই পরম প্রিয় বস্তু ৷ কিন্তু আনন্দ তাহা হইতেও প্রিয়তর ৷ তাই লোকে জীবন বিপন্ন করিয়াও আনন্দলাভের চেষ্টা করিয়া থাকে ৷

লোকে অর্থলাভের জন্য অরণ্যে প্রান্তরে, গিরি শিখরে, সমুদ্রে বিচরণ করে ৷ অর্থের জন্য মুটে মজুর হইতে জজ ম্যাজিস্ট্রেট, গভর্নর ভাইসরয় পর্যন্ত কতই না কষ্ট স্বীকার করেন ; অর্থের জন্য লোকে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হইয়া কিভাবে জীবন বিপন্ন করে, ভাবিলেও ভয় হয় ৷ পিতা পুত্রের জন্য কত কষ্ট করেন, মাতা গর্ভধারণ, প্রসব, সন্তান পালনের দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেন ৷ তাহাদের তুলনায় আমার কষ্ট, কষ্ট বলিয়া গণ্য হইতে পারে না ৷ আমি যে সুখের আশায় এই নামমাত্র কষ্ট সহিতেছি, সেই সুখ এই জগতের কোন বস্তু হইতেই পাওয়া যায় না ৷ আমার ঠাকুর আমায় বিনা capital -এ, সবচেয়ে বেশি profitable business করিতে দিয়াছেন ৷ এমন ঠাকুরের আশ্রয়ে আছি ৷ আমার কি দুঃখ ? এই শরীর দুদিন পরে শেয়ালে কুকুরে খাবে ; আর একটু কষ্ট যদি হয়, হউক ৷

আপনাকে শ্রীরামকৃষ্ণ চরণাশ্রয় দিয়াছেন — আর ভাবনা নাই ৷ তিনি জগতের মালিক ৷ তিনি আপনাকেও আমার মতো, তাঁর ইচ্ছা হইলে আমা হইতে আরও বেশি, আনন্দ দিবেন ৷ তিনি ইচ্ছাময়, তাঁর কৃপাই আমাদের একমাত্র ভরসা ৷ আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি :

(১) যাহারা এই দেহ ছাড়িয়া নূতন দেহ না পায় এবং বীজাকারে থাকে তাহাদের হুঁশ থাকে না ৷ কোন অনুভূতিই তখন হয় না ৷

(২) ভালো মন্দ কাজের ফল এই জগতেই হয় ৷ তাই তো নানা জীবের নানাপ্রকার সুখ ও দুঃখ আমরা এই জগতে দেখিতে পাই ৷

(৩) একটা কুকুর বড় লোকের আদরে রাজসুখ ভোগ করে ; একজন শিক্ষিত বিদ্বান, সৎ প্রকৃতি ব্রাহ্মণ দারিদ্র্যে অপমানে জীবন কাটায় ৷ ইহাই কর্মফল ভোগ ৷ এই স্থূল দেহে এই জগতে এবং সুক্ষ সুক্ষ দেহে সুক্ষ জগতের মধ্যেও, যেসব দুঃখ ভোগ হয় তাহাই কর্মফল ভোগ ৷ দেবতাদেরও দুঃখভোগ হয় ৷ চণ্ডীতে দেবতাদের দুঃখের বর্ণনা আছে ৷

(৪) নরক বলিয়া এক নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র স্থানের বর্ণনা শাস্ত্রে আছে ৷ তাহা অশিক্ষিত লোককে কর্মফল ভোগ বুঝাইবার জন্য মাত্র ৷ স্থূল দেহে মানুষ হইতে বিষ্ঠার কীট পর্যন্ত সকলেই দুঃখ ও সুখ ভোগ করে ৷ সূক্ষ্ম দেহে প্রেত হইতে ব্রহ্মা পর্যন্ত সকলেরই সুখ-দুঃখ আছে ৷ নরক বলিয়া স্বতন্ত্র কোন স্থান নাই ৷

Prabrajika Mokshya Prana Mataji s spiritual Msj

l

প্রব্রাজিকা মোক্ষপ্রাণা মাতাজীর পত্রের কিছু অংশ :~
~~~~~~~~

পার্থিব বস্তুর পিছনে যত ছোটাছুটি, এটি না করে নিত্য বস্তুর জন্য যদি মানুষ অগ্রসর হয়, তাহলে তার নিজেরই শান্তি ৷

কিন্তু দ্যাখো মা — নিত্য বস্তু এবং অনিত্য বস্তুর প্রভেদটা নিজে দৃঢ় নিশ্চিত হয়ে না নিলে, পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা তোমাকে কেবলই খোঁচাবে এবং উত্যক্ত করবে ৷

এর জন্য শাস্ত্রে কি বলেছেন জান — ‘তপঃ-স্বাধ্যায়-ঈশ্বরপ্রণিধানানি ৷’ অর্থাৎ প্রতিদিন একই নিয়মে জপতপ করবে, শাস্ত্রপাঠ করবে ও ভগবানকে ভালোবাসবে, ভক্তি করবে ৷ নাহলে সংসারের সামান্য চাকচিক্যে আবার ভেসে যাবে ৷

এরজন্য ঠাকুর চারাগাছের চারদিকে বেড়া দিতে বলছেন — নতুবা ছাগল-গরুতে মুড়িয়ে খেয়ে যাবে ৷

যদি প্রতিদিন বিচার ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে মনকে দৃঢ়নিশ্চয় করে নিতে পার, এবং নিজে সতর্ক, সচেতন থাক, তবেই বাঁচবে — নাহলে মন নিচে নামল কি, তার মৃত্যু !l

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

তুমি গুরুদর্শনে যাইতে পার নাই বলিয়া দুঃখিত আছ ৷ দর্শন হইতে এই দুঃখ শ্রেয় ৷ দর্শন করিয়া কিছুই বুঝা যায় না কিন্তু দর্শনের অভাবে যে দুঃখ হয় তাহাতে আকর্ষন বাড়ে ৷

পুরুষকার ও দৈব বলিয়া দুই বিভিন্ন শক্তি নাই ৷ পূর্বকৃত পুরুষকার সঞ্চিত থাকে, পরে যখন তার ফল প্রকাশ পায় তখন মানুষ মনে করে ইহা বুঝি আকাশস্থিত কোন দেবতা করিয়া দিলেন ৷ মানুষ জানে না সে পূর্ব পূর্ব জন্মে কত সৎ এবং অসৎ কার্য করিয়াছে ৷ সে দেখিল যে কার্যে তাহার বন্ধু চারি আনা পরিশ্রম করিয়া ষোল আনা ফল পাইল এবং সে নিজে আঠার আনা করিয়া আশানুরূপ ফল লাভ করিল না ৷

…. তুমি তো দেখিতেছ যদিও এই দেহের কর্তা ‘জীব’ তথাপি বাহ্য দৃষ্টিতে ‘হজম করা’ প্রভৃতি কার্যে তাহার কর্তৃত্ব দৃষ্ট হয় না ৷ ঘোড়া চালাইতে গিয়া আমরা ঘোড়া কর্তৃকই চালিত হইতেছি ৷ কর্ম যদিও আমার অধীন কিন্তু একবার কর্ম করিয়া ফেলিলে তাহার ফল নিবারণ করিতে পারি না ৷ পূর্বে কি করিয়াছি মনে নাই এখন কম চেষ্টায় বা বিনা চেষ্টায় কোন ফল পাইলে মনে করি স্বর্গের দেবতার দান, আর না পাইলে মনে করি দেবতার রোষ ৷

পূর্ব জন্মে যেসব দুষ্কার্যে দারিদ্র দোষ হয়, তাহা প্রাণ ভরিয়া করিয়াছি ৷ এ জন্মে সেসব কিছুই মনে নাই ৷ কিন্তু শত চেষ্টায়ও ধন লাভ হইতেছে না ৷ পুরোহিত ঠাকুর কোষ্ঠী দেখিয়া বলিলেন, ‘শনি রূষ্ট ৷’ বুঝিলাম যত দোষ ঐ অহিতকারী শনির ৷ কিন্তু যেসব কার্য করিয়া শনিকে রূষ্ট করিয়াছি তাহার কথা আর কুষ্ঠীতে লেখে না ৷ অতএব দৈব আমার পূর্বকৃত কর্মের ফল মাত্র ৷

সুতরাং আমার সম্বন্ধে কিছু ঘটিতেছে সবই একমাত্র ‘পুরুষকার’ কৃত ৷ এই পুরুষকার অহঙ্কার হইতে জন্ম ৷ অহঙ্কার অজ্ঞানজ ৷ যাহাতে অজ্ঞান, অহঙ্কার পুরুষকার প্রভৃতির হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায় তজ্জন্য মায়াধীশ আমার আত্মাস্বরূপ ( real self ) ভগবানকে ডাকি, তাঁহার শরণ লই, তাঁহার স্বরূপ চিন্তা করি ৷ যতদিন মায়ার ভিতর আছি, ততদিন পুরুষকার অবলম্বন করিয়া কর্মফল ভোগ করিতে হইবে ৷ কর্মফল দাতা ঈশ্বর আমার হৃদয়ে বাস করিয়া আমার কর্ম নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন ৷ মায়ার ভিতরে আছি সুতরাং অহঙ্কার আছে এবং কর্ম না করিয়া থাকিতে পারি না ; সুতরাং কর্মফল ভোগ করিতে হয় ৷

গীতাতে দৈবের দিকে কিছুমাত্র ঝোঁক নাই ৷ বরং পুরুষকারের দিকেই টানিয়াছেন ৷ ভগবানের শরণাগতি প্রভৃতি আলাদা ৷ পুরুষকার অহঙ্কার সব দূর হইয়া যখন জীব নৈস্কর্মসিদ্ধি লাভ করে, তখন সকল কর্মের অবসান হয় ৷

জীবের যখন জ্ঞান হয় তখন দেখে পুরুষকার কর্মফল সবই ভ্রম ৷ একমাত্র কর্তা ভোক্তা ঈশ্বরই আছেন ৷ সেই জ্ঞান হইলে দেখা যায় তিনি প্রেমময়, দয়াময়, অহেতুক কৃপাসিন্ধু ৷ তার পূর্বে পুরুষকার ছাড়িয়া দিলে জীবের সর্বনাশ হয় ৷ সমস্ত ভারতবর্ষ ঐ দৈববাদের ভ্রমে পড়িয়া ঘোর তমোগুণে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে ৷ ….এই ভাবিয়া ফল নাই ৷ মন খারাপ করিও না ৷ প্রফুল্ল মনে তোমার কর্তব্য মন দিয়া করিয়া যাও ৷ নিজে প্রফুল্ল থাক অন্যকে প্রফুল্ল রাখ ৷ পিতামাতাকে খুশি ও সুখী রাখিও ৷ যতদূর পার সহ্য কর ৷ ভুয়া moralist অপেক্ষা পিতৃমাতৃভক্ত বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ৷

Gahan Anand Chintan

।। তোমাদের কাছে এলাম ।।
স্বামী চেতনানন্দ

বাড়িটার নম্বর ৩০৯ মন্টেরি রোড, দক্ষিণ প্যাসাডেনা, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে একটি ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে জিনিসপত্র হাতে বিবেকানন্দ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেঁকে বললেন, 'তোমাদের কাছে এলাম থাকতে।'
কত কালের তপস্যা থাকলে বিবেকানন্দের মতো অতিথি পাওয়া যায় মীড ভগিনীত্রয় তা জানত। এরা স্বামীজির বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। এদের সম্বন্ধে স্বামীজী লিখেছিলেন : "এরা ঈশ্বর কর্তৃক আশীর্বাদপুষ্ট। এই তিনটি বোন তিনটি দেবদূতী। এরা খাঁটি পবিত্র এবং সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থপর।" মীড ভগিনীদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় বলে গেলেন : "তোমরা তিনটি ভগিনী আমার মনের সঙ্গে চিরদিনের মত একীভূত হয়ে রইলে।" মধ্যম ভগিনী মিসেস হ্যান্সব্রো (শান্তি) স্বামীজীর সেক্রেটারির কাজ করেছিল।
বাড়িটির বর্তমান নাম 'বিবেকানন্দ কুটির'। এখানে স্বামীজী ছয় সপ্তাহ ছিলেন। এখন বাড়িটি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বেদান্ত সোসাইটির সম্পত্তি। প্রতি বছর এখানে স্বামীজীর স্মৃতি উৎসব হয়। এবারও হয়েছিল ১০ জুলাই (১৯৭১), বিকাল ৪টায়।
আড়ম্বরহীন উৎসবটি দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। প্রায় একশো আমেরিকান মেয়ে-পুরুষ এল স্বামীজীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে। ছোট বাড়ি। ওপরে স্বামীজী যে ঘরে থাকতেন, সেটি এখন মন্দির। স্বামীজীর বিরাট ধ্যান মূর্তির ছবি। সবাই ধ্যান করল অনেকক্ষণ ধরে। কয়েকটি আমেরিকান মেয়ে সুন্দর গলায় হারমোনিয়াম ও তানপুরা যোগে 'মূর্তমহেশ্বর...' গানটি এমন আবেগের সঙ্গে গাইল যে সারা বাড়িটা গমগম করতে লাগল।
তারপর শুরু হলো পাঠ -- এই বাড়িটার সঙ্গে বিজড়িত স্বামীজীর যত সব কথা। পাঠের পর মেয়েভক্তেরা সবাইকে পরিবেশন করল কেক, বিস্কুট, চা, কফি, সরবৎ। একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান।
গ্রেগ, জন ও ডগলাস নামে তিনটি ছাত্র থাকে বাড়িটাতে, রক্ষক হিসাবে। এরাই বাড়িটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। এরা ফুলের বাগান করে, বাড়ি রং করে, স্বামীজীর ঘরে বসে ধ্যান করে, আবার স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে। মানুষ থাকে না কিন্তু স্মৃতি থাকে। বিবেক-স্মৃতি অবলম্বন করে ঐ তরুণ ছেলেরা জীবনের নিশানা খুঁজছে।
('বহুরূপে বিবেকানন্দ' বই থেকে)

Swami Premeshanandaji’s collection

আশ্চর্য ব্যাপারই বটে। জড় বস্তু নিয়া থাকি, তাই জড়ের গুণ inertia-কে সত্য বস্তু জ্ঞান করিয়া কষ্ট পাই। বিষয় বাসনা মানে পূর্বাভ্যস্ত বিষয়ের দিকে মনের ঝোঁক। তাহা inertia ছাড়া আর কিছুই নহে। এই জন্মেই কত দিকে মনের টান দেখি। আবার কিছুদিন পর একদিকের টান অন্যদিকে চলে যায়। যাকে আজ না দেখে থাকতে পারি না, দশ বৎসর পর হয়তো তার কথা মনেও থাকবে না! তাই তো ভগবান বলেছেন— অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে। অভ্যাসে কি না হয়। এই জগতের দুঃখ মোচনের প্রধান উপায় অভ্যাস। তাই সন্ন্যাসীরা পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ায়!

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

তুমি রামকৃষ্ণ চরণাশ্রিত ৷ তোমাকে তিনি সর্বদা রক্ষা করিবেন ৷ তবে নিজের ছেলেকেও সাঁতার শিখাইতে হইলে, জলে ফেলিতে হয় এবং একটু-আধটু নাকানি-চুবানি খাওয়াইতে হয় । তুমি মোটেও ঘাবড়াইও না, ঘাবড়াইবার কোনও হেতুই নাই ৷ “রাখে কৃষ্ণ মারে কে মারে কৃষ্ণ রাখে কে ?”

এ যে খেলা গো ! তোমার এই যে থিয়েটার তা না হয় পঞ্চাশ বছর চলিবে ; তারপর যবনিকা পতন অনিবার্য ৷ তারপর পঞ্চাশ কোটি বৎসর অর্থাৎ অনন্তকাল কেবলই সুখ — দুঃখের লেশমাত্র থাকিবে না ৷ ইচ্ছা করিলে যদি তুমি চাও, ঠাকুর-মা-স্বামীজী আমরা সকলকে নিয়া নিত্য উৎসব করিব ; আমরা চিদানন্দ সিন্ধু নীরে কেবল আনন্দ লহরী গণিব ৷

ঠাকুর সর্বদা একটা গান না কি গাইতেন, মাস্টার মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছিলাম ৷ সেই গানটি তুমি সর্বদা গাইতে অভ্যাস কর ৷

“হরি নাম নিতে অলস হইও না, মন, যা হবার তা হবে ৷
দুঃখ পেয়েছ, না হয় আরও পাবে ৷
ঐহিকের সুখ হলো না বলে কি ‘ঢেউ দেখে না’ ডুবাবে ?”

ওখানে সঙ্গীহীন হয়েছ ? ভালই হলো ৷ কেবল ধর্মগ্রন্থ পড়বে, আর ভাববে ‘Good thoughts my best companions ৷’

নির্জনে একান্তে নিঃসঙ্গ থাকা যদি অভ্যাস হয়ে যায়, তবে কত যে উন্নতি হবে, তাহা আশা করি তুমি বুঝিবে ৷ আর চারিদিকে অশান্তি মৃত্যুভয়ও তোমাকে ঠাকুরের কোল ঘেঁসিয়া থাকিতে বাধ্য করিবে ; ‘গৃহীত ইব কেশেষু মৃত্যুনা ধর্মমাচরেৎ ৷’ যম চুল ধরিয়া টানিতেছে এই ভাবনা না ভাবিলে কি মানুষের মনে ঈশ্বর চিন্তা হয় ?

মোট কথা বিপদকে সম্পদ, দুঃখকে সুখের হেতু করিতে যে তুমি সমর্থ এ কথা আমি জোর করিয়াই বলিতেছি । কারণ তুমি শ্রীরামকৃষ্ণের নাতি ।

তুমি মন হইতে দুঃখ, হতাশা ও ভয়কে দূর করিয়া দাও ৷ অবশ্য হঠাৎ চট করিয়া তা হইবে না ৷ কিন্তু খুব দৃঢ়ভাবে ঐ ধারণাগুলি ধরিয়া রাখিলে সব ভাবনা দূর হইবে, অন্তত খুব কমিয়া যাইবে ৷

মন প্রসন্ন না থাকিলে বুদ্ধি স্থির থাকে না ৷ তাই সর্বাগ্রে মন প্রসন্ন করিবার চেষ্টা কর — ‘প্রসন্নচেতস্য হ্যাশু বুদ্ধি পর্যবতিষ্ঠতে ৷’ খুব সাহসের সহিত রুখিয়া দাঁড়াও ৷ পেছন হটা মরণের সমান জানিবে ৷

Design a site like this with WordPress.com
Get started