🌷🌷 জয় ঠাকুর 🌷🌷
ধর্ম জিনিসটা শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, ধর্ম একটা আস্বাদনের বস্তু ৷ এই আস্বাদনই আমাদের শ্রীভগবানের দিকে আকর্ষণ করে ৷ অনুভূতি না থাকলে ধর্ম শুকনো হতো ৷ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এই অনুভূতির একটা বড়ো দৃষ্টান্ত ৷
সত্যের যত দিক আছে, তিনি সব দেখেছেন ৷ ঈশ্বরের ভাব অনন্ত, কাজেই তাঁর জন্য সাধনা অনন্ত, ঈশ্বরলাভের পথও অনন্ত ৷ ঠাকুরের সাধনার শেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর কাছে ছুটে এসে তাঁর অনুভূতির কথা শুনে অবাক হয়ে যেত । সত্য এক, কিন্তু তাকে ঠাকুরের মতো এতভাবে দর্শন ও অনুভূতি কেউ করেননি ৷ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ দর্শন করা, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা ও ঘনিষ্ঠ আলাপ আর কারো কাছে এত বেশি শোনা যায়নি ৷ সিঁতির ব্রাহ্মসমাজে ত্রৈলোক্য, বিজয়কৃষ্ণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তদের তিনি বলেছিলেন, “ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে খুঁজলে তাঁকে দর্শন হয়, তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়, কথা হয়, যেমন আমি তোমাদের সঙ্গে কচ্ছি ৷ সত্য বলছি দর্শন হয় ।”
ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব চলেছিল ঠাকুরের আগমনের পূর্ব থেকেই ৷ প্রত্যেক সম্প্রদায় দাবি করছিল তাদের ভাবটি শুধু সত্য, আর সব মিথ্যা ৷ সেই দুর্দিনে ঠাকুরের আবির্ভাব ৷ তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন, বললেন, যত মত তত পথ ৷ তাঁর সাধনা উপদেশে এই একটা মস্ত বিরোধ চিরদিনের জন্য মিটে গেছে ।
ঠাকুর হাতীর দৃষ্টান্ত দিলেন ৷ কজন অন্ধ ব্যক্তি একটা হাতীর কাছে এসে পড়েছিল ৷ কেউ তাদের বলে দিলে, এর নাম হাতী ৷ তারা হাতীর গা স্পর্শ করে দেখলে ৷ তাদের মধ্যে একজন বললে, হাতীটা থামের মতো, — সে কেবল হাতীর পা’টা ছুঁয়েছিল ৷ আর একজন বললে, হাতীটা কুলোর মতো, — সে হাতীর কানটা শুধু ছুঁয়েছিল ৷ বাকি যারা হাতীর শুঁড় বা লেজে হাত দিয়েছিল তারা অন্য রকম বলতে লাগলো ৷
তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধে যাঁর যে-রকম অনুভূতি, তিনি মনে করেছিলেন, — ঈশ্বর সেই রকম, অন্য কোনরকম নয় ৷ ঠাকুর গোটা হাতীটাকে দেখলেন, সবটা প্রত্যক্ষ করলেন, অনুভুতি করলেন ৷ ব্রাহ্মকে তিনি ব্রাহ্মভাবে রাঙিয়ে দিয়েছেন, শাক্তকে শাক্তভাবে, বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবভাবে ৷ যে-ধর্মমতেরই লোক তাঁর কাছে আসতো, ঠাকুর তাকে তার নিজভাবেই রাঙিয়ে দিতেন ৷ তাই তো তিনি জগদ্ গুরু ৷
মাদ্রাজের একজন বড় পন্ডিতের সঙ্গে আমার দেখা হয় ৷ তিনি বললেন, “ঠাকুরের বাণী যেন মাথা ডিঙিয়ে একেবারে হৃদয়ে প্রবেশ করে ৷ তাই তো তাঁর কথা মাথা পেতে নিতে হয়, বিচার করে বুঝতে হয় না ৷”
তন্ত্র-সাধনের সময় তিনি ভৈরবী ব্রাহ্মণীর এবং বেদান্ত-সাধনের সময় তোতাপুরীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ৷ বেদান্তের চরম সাধন তিনি মাত্র তিন দিনে শেষ করলেন — যা করতে গুরু তোতাপুরীর লেগেছিল দীর্ঘ চল্লিশ বছর ৷ তোতাপুরী অরূপের ধ্যান করতেন, শুধু অরূপেরই অনুভূতি ছিল তাঁর, ভৈরবী অদ্বৈত মানতেন না ৷ ভৈরবী ও তোতাপুরীর যেখানে যেটুকু অপূর্ণতা ছিল, ঠাকুরই তা পূরণ করে তাঁদের ধন্য করেছিলেন ৷
ঠাকুরের প্রত্যক্ষ দর্শনের কাছে সবাই চুপ হয়ে যেত ৷ একজন কাশীর কথা বই-এ পড়েছে, আর একজন কাশী দেখেছে, দুজনের মধ্যে ঢের তফাৎ ৷
ঠাকুর বললেন, “দয়া নয়, পরোপকার নয়, সর্বভূতে হরি রয়েছেন, তাঁরই সেবা ৷ এই সেবার মূলে যদি নামযশ প্রত্যুপকারের আশা কিংবা স্বর্গকামনা না থাকে, তবে তাই হলো গীতার নিষ্কাম কর্ম ৷
স্বামীজি পাঁচ-ছ’ বছর ধরে ঠাকুরকে সবরকমে বাজিয়ে নিয়েছিলেন ৷ একদিন লুকিয়ে তাঁর বিছানার নিচে একটা টাকা রেখে দেন ৷ সেই খাটে বসামাত্র ঠাকুর যেন বিছার কামড় খেয়ে ছটফট করতে থাকেন ৷ তখন স্বামীজি তাঁর পা-দুটি জড়িয়ে ক্ষমাভিক্ষা করেন ৷
গঙ্গার ধারে বসে ঠাকুর ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ বিচার করে দুটোই গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিলেন ৷ টাকাটা ফেলে দেওয়ার মানে বিষয়াকাঙ্খা ভোগবাসনা ত্যাগ করা, নিবৃত্তিমার্গ আশ্রয় করা ৷
ভোগবাসনাই তো মানুষকে সংসারে আবদ্ধ করে রেখেছে ৷ উপনিষদের ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ভোগের মধ্য দিয়ে অমৃতত্ত্ব লাভ করা যায় না ৷ এ-যুগে ঠাকুর আবার সেই অমৃতত্বের পথ দেখিয়ে গেছেন ৷ ত্যাগই আমাদের আদর্শ ৷ ঠাকুর ত্যাগীশ্বর, আর তাঁর সন্তানদের সকলেরই জীবন ত্যাগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ৷
ঈশ্বরের সত্তায় আমরা টিকে আছি । তিনি আমাদের এত নিকট, এত কাছে, আর আমরা কিনা আমাদের প্রেম-প্রীতি ভালবাসা সব অন্যত্র বিলিয়ে বসে আছি ! এই ছড়ানো ভালবাসা-প্রেম-প্রীতিকে বিষয় থেকে গুটিয়ে এনে অন্তর্মুখী — ঈশ্বরমুখী করতে হবে ৷ জগদ্ গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবন ও সাধনা দিয়ে এ-যুগে এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন ।
— স্বামী বিশুদ্ধানন্দজী ৷