vairagyashatkam (6)

বৈরাগ্যশতকম্, তৃষ্ণাদুষণম্-০৬

ক্ষান্তং ন ক্ষময়া গৃহোচিতসুখং ত্যক্তং ন সন্তোষতঃ, সোঢ়া দুঃসহশীতবাততপনক্লেশা ন তপ্তং তপঃ। ধ্যাতং বিত্তমহর্নিশং নিয়মিতপ্রাণৈর্ন শস্তোঃ পদং, তত্তৎ কর্ম কৃতং যদেব মুনিভি স্তৈস্তৈ: ফলৈবঞ্চিতা: ॥ ৬ ॥

আমি অনেকবার অপমানিত হয়ে অনেককে ক্ষমা করেছি বটে, কিন্তু তা প্রতিশোধ প্রবনতার নিরর্থকতা ভেবে নয়, আমি তা করেছি কারণ সেই সমস্ত লোকের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি অনেক সময় ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ত্যাগ করেছি বটে কিন্তু তা বৈরাগ্যের বুদ্ধিতে নয়, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে করেছি। বানিজ্যের জন্য ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় কত শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকালীন কষ্ট সহ্য করেছি ,কিন্তু নিজের আত্মিক উন্নতির জন্য কিছুই করিনি। দিন রাত শুধু বিষয়চিন্তা করেছি, কিন্তু মুহুর্তের জন্যেও আত্মচিন্তা করিনি। একজন সাধক তাঁর সাধনার জন্য যা যা প্রচলিত তপস্যা করেন সেই সব কর্ম করার সত্ত্বেও বিষয়াসক্তি কামড়ে থাকায় আমি যোগী হতে পারিনি।

SWAMI VIVEKANANDA

যথার্থ বিবেকানন্দ অনুসরণ
( চাই একটি আদর্শ জীবন )
ব্রহ্মচারী শুভব্রত মহারাজ
বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন

স্বামী বিবেকানন্দকে আমরা যারা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি কিভাবে বোঝা যাবে যে ঠিকঠিক সেই আদর্শকে অনুসরণ করছি কিনা??

    স্বামী বিবেকানন্দের ফটোকে রোজ মালা পরিয়ে পূজা করা বা তার জন্মদিনে বেলুড় মঠ যাওয়া বা বিভিন্ন বক্তৃতা শোনা, তাঁর সম্পর্কে অনেক বই পড়া ....... এইগুলিই কি কেবলমাত্র স্বামিজীর আদর্শকে মেনে চলা?? কেউ 50 বার বেলুড় মঠ গেছে, 100 টা বক্তৃতা শুনেছে, 50 টা বই পড়েছে, সাধুদের সাথে, পন্ডিতদের সাথে যোগাযোগও আছে, ফেসবুক, হোয়াটস আপ এ বিভিন্ন বাণী ও কথাও পড়ে বা পোস্ট করে। সেই ব্যক্তিও কি তাহলে স্বামীজিকে অনুসরণ করছে ঠিকঠিক??
   হ্যাঁ, এইগুলি অবশ্যই একধরনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা নিশ্চিতভাবে। এইগুলি প্রাথমিক স্তর। কিন্তু যথার্থ ভাবে বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসাবে নিতে গেলে তাঁর জীবন ও বানীর আলোকে আমাদের নিজেদের জীবন গঠন করতে হবে। তিনি ঠিক যেরকম চেয়েছেন আমাদের ঠিক সেইরকম হতে হবে বা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একমাত্র তখনই হবে স্বামীজিকে প্রকৃত গ্রহণ বা যথার্থ অনুসরণ। সেটাই হবে তাঁর প্রতি দেখানো সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা। 
  1. স্বামীজিকে যথার্থ যিনি অনুসরণ করবেন তার জীবন হবে সৎ ও পবিত্র।
    2.সংযমের জীবন হবে। কোনো অবস্থাতেই তিনি লোভ বা কামনার বশবর্তী হয়ে সততা বিসর্জন দেবেন না।
  2. তিনি নিঃস্বার্থপর হবেন। স্বামীজী বলছেন, “পবিত্র ও নিঃস্বার্থ হতে চেষ্টা করো তার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম।”
  3. তিনি মনুষত্ববোধে পরিপূর্ণ হবেন। মানবিক হবেন। স্বামীজী বলছেন,”এসো মানুষ হও ” প্রকৃত মানুষ হতে হবে।
  4. তার মধ্যে থাকবে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাস।
  5. তিনি অবশ্যই চরিত্রবান হবেন। স্বামীজী বলছেন, “মনে রাখবে, ব্যাক্তিগত চরিত্র ও জীবনই শক্তির উৎস অন্য কিছু নয়।”
  6. তিনি হবেন খুব শ্রদ্ধাশীল।
  7. সকলকে নিয়ে মিলেমিশে কাজ করার যোগ্যতা থাকতে হবে।
  8. তিনি হবেন অকপট। কোনো রকম ছল বা শঠতা তার মধ্যে থাকবে না।
  9. তিনি হবেন সাহসী ও সহানুভুতি সম্পন্ন। খুব উদ্যমী হবেন।
  10. মাতৃজাতীর প্রতি তার থাকবে বিনম্র শ্রদ্ধা। মেয়েদের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। মেয়েদের ঈশ্বরজ্ঞানে দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে হবে। শুধু তাই নয় মেয়েদের উন্নতির জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিতে হবে। স্বামীজী বলেছেন,”মেয়েদের নিচে ফেলে কেউ উঠতে পারে না।” তিনি আরো বলেছেন,” যেখানে স্ত্রী লোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে-সংসারের সে-দেশের উন্নতির কখনো আশা নেই।”
  11. তিনি সত্য কে সর্বদা ধরে থাকবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি সত্যকে ছাড়বেন না। তিনি সত্যবাদী হবেন। স্বামীজী বলছেন,”সত্যের জন্য সবকিছুকেই ত্যাগ করা চলে কিন্ত কোনো কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা চলে না।”
  12. তিনি সরল হবেন। সরল নাহলে তিনি কখনো যথার্থ আধ্যাত্মিক হতে পারবেন না।
  13. তিনি সর্বদা নিজের লক্ষ্যে দৃঢ় ও অবিচল থাকবেন।
  14. তিনি নাম যশ ও প্রভুত্বস্পৃহা বিসর্জন দেবেন ও কাজ করবেন।
  15. তিনি সর্বদা দীন দরিদ্র অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবেন। তাদের দেবতাজ্ঞানে সেবা করবেন।
  16. তিনি তার মাতা পিতাকে দেবদেবী জ্ঞানে সেবা করবেন ও শ্রদ্ধা করবেন।
  17. তিনি প্রকৃত শিক্ষিত হবেন ও ওপরের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবেন।
  18. তিনি সমদর্শী হবেন। সকলের ওপর তার সমান ভালোবাসা থাকবে। তিনি সকলকে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করবেন।
  19. তিনি নিজে আদর্শ জীবন যাপন করবেন ও অপরকে উৎসাহ দেবেন নৈতিক আদর্শ জীবন যাপনের জন্য। তার জীবনই হবে সকলের কাছে উদাহরণস্বরূপ। আরও আছে। মোটামুটি এই লক্ষণগুলি বা সদগুনগুলিকে যদি জীবনে ফুটিয়ে তোলা যায় তবেই হবে স্বামী বিবেকানন্দকে যথার্থ অনুসরণ। এইগুলি যে পুরুষ বা নারীর মধ্যে প্রকাশ হতে শুরু করেছে বা অনুশীলন করছেন তাকেই বলা যাবে প্রকৃত বিবেকানন্দ অনুরাগী। তিনি একজন শিক্ষিক বা শিক্ষিকা হতে পারেন, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেন, তিনি একজন ছাত্র বা ছাত্রী হতে পারেন, তিনি একজন অফিসার বা সাধারণ কর্মী হতে পারেন, বা তিনি একজন বাবসাদারও হতে পারেন। আজকের বর্তমান সমাজে চাই এইরকম বিবেকানন্দময় বা যথার্থ বিবেকানন্দ অনুরাগী একটি আদর্শ জীবন। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে প্রার্থনা করি অন্তর থেকে আমরা যেন ঠিকঠিক সেইরকম যথার্থ অনুরাগী হতে পারি ঠিক তিনি যেরকম চাইতেন। এইরকম জীবন যত তৈরি হবে পৃথিবীর বুকে তত পৃথিবীর সামাজিক পরিবেশ বদলে যাবে। আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বক্ষেত্রে এক পবিত্র নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এক আদর্শ নৈতিক সমাজ। শান্তি ও অহিংসার সমাজ।

Kathamrito

“তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌ ৷
শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ ৷৷”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২৫শে জুন

শুধু পাণ্ডিত্য মিথ্যা — সাধনা ও বিবেক-বৈরাগ্য

সমাধির কথা বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবান্তর হইল। তাঁহার চন্দ্রমুখ হইতে স্বর্গীয় জ্যোতিঃ বহির্গত হইতেছে। আর বাহ্যজ্ঞান নাই। মুখে একটি কথা নাই। নেত্র স্থির! নিশ্চয়ই জগতের নাথকে দর্শন করিতেছেন! অনেকক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া বালকের ন্যায় বলিতেছেন, “আমি জল খাব।” সমাধির পর যখন জল খাইতে চাহিতেন তখন ভক্তেরা জানিতে পারিতেন যে, এবার ইনি ক্রমশঃ বাহ্যজ্ঞান লাভ করিবেন।

ঠাকুর ভাবে বলিতে লাগিলেন, “মা! সেদিন ঈশ্বর বিদ্যাসাগরকে দেখালি!” তারপর আমি আবার বলেছিলাম, “মা! আমি আর-একজন পণ্ডিতকে দেখব, তাই তুই আমায় এখানে এনেছিস।”

পরে শশধরের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “বাবা! আর একটু বল বাড়াও, আর কিছুদিন সাধন-ভজন কর। গাছে না উঠতেই এককাঁদি; তবে তুমি লোকের ভালর জন্য এ-সব করছ।”

এই বলিয়া ঠাকুর শশধরকে মাথা নোয়াইয়া নমস্কার করিতেছেন।

আরও বলিতেছেন, “যখন প্রথমে তোমার কথা শুনলুম, জিজ্ঞাসা করলুম যে, এই পণ্ডিত কি শুধু পণ্ডিত, না, বিবেক-বৈরাগ্য আছে?”

[আদেশ না পেলে আচার্য হওয়া যায় না ]

“যে পণ্ডিতের বিবেক নাই, সে পণ্ডিতই নয়।

“যদি আদেশ হয়ে থাাকে, তাহলে লোকশিক্ষায় দোষ নাই। আদেশ পেয়ে যদি কেউ লোকশিক্ষা দেয়, তাকে কেউ হারাতে পারে না।

“বাগ্বাদিনীর কাছ থেকে যদি একটি কিরণ আসে, তাহলে এমন শক্তি হয় যে, বড় বড় পণ্ডিতগুলো কেঁচোর মতো হয়ে যায়।

“প্রদীপ জ্বাললে বাদুলে পোকাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আপনি আসে — ডাকতে হয় না। তেমনি যে আদেশ পেয়েছে, তার লোক ডাকতে হয় না; অমুক সময়ে লেকচার হবে বলে, খবর পাঠাতে হয় না। তার নিজের এমনি টান যে লোক তার কাছে আপনি আসে। তখন রাজা, বাবু, সকলে দলে দলে আসে। আর বলতে থাকে আপনি কি লবেন? আম, সন্দেশ, টাকা-কড়ি, শাল — এই সব এনেছি; আপনি কি লবেন? আমি যে সকল লোককে বলি, ‘দূর কর — আমার ও-সব ভাল লাগে না, আমি কিছু চাই না।’

“চুম্বক পাথর কি লোহাকে বলে, তুমি আমার কাছে এস? এস বলতে হয় না, — লোহা আপনি চুম্বক পাথরের টানে ছুটে আসে।

“এরূপ লোক, পণ্ডিত নয় বটে। তা বলে মনে করো না যে তার জ্ঞানের কিছু কম্‌তি হয়। বই পড়ে কি জ্ঞান হয়? যে আদেশ পেয়েছে তার জ্ঞানের শেষ নাই। সে জ্ঞান ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে, — ফুরায় না।

“ও-দেশে ধান মাপবার সময় একজন মাপে, আর-একজন রাশ ঠেলে দেয়; তেমনি যে আদেশ পায় সে যত লোকশিক্ষা দিতে থাকে, মা তাহার পেছন থেকে জ্ঞানের রাশ ঠেলে ঠেলে দেন। সে-জ্ঞান আর ফুরায় না।

“মার যদি একবার কটাক্ষ হয়, তাহলে কি আর জ্ঞানের অভাব থাকে? তাই জিজ্ঞাসা করছি কোন আদেশ পেয়েছ কি না?”

হাজরা — হাঁ, অবশ্য আদেশ পেয়েছেন। কেমন মহাশয়?

পণ্ডিত — না, আদেশ? তা এমন কিছু পাই নাই।

গৃহস্বামী — আদেশ পান নাই বটে, কর্তব্যবোধে লেকচার দিচ্ছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — যে আদেশ পায় নাই, তার লেকচার কি হবে?

“একজন (ব্রাহ্ম) লেকচার দিতে দিতে বলেছিল, ‘ভাইরে, আমি কত মদ খেতুম, হেন করতাম, তেন করতাম।’ এই কথা শুনে, লোকগুলি বলাবলি করতে লাগল, ‘শালা, বলে কিরে? মদ খেত!’ এই কথা বলাতে উলটো উৎপত্তি হল। তাই ভাল লোক না হলে লেকচারে কোন উপকার হয় না।

“বরিশালে বাড়ি একজন সদরওয়ালা বলেছিল, ‘মহাশয়, আপনি প্রচার করতে আরম্ভ করুন। তাহলে আমিও কোমর বাঁধি।’ আমি বললাম, ওগো একটা গল্প শোন — ও-দেশে হালদার-পুকুর বলে একটি পুকুর আছে। যত লোক তার পাড়ে বাহ্যে করত। সকাল বেলা যারা পুকুরে আসত গালাগালে তাদের ভূত ছাড়িয়ে দিত। কিন্তু গালাগালে কোন কাজ হত না; আবার তার পরদিন সকালে পাড়ে বাহ্যে করেছে, লোকে দেখত। কিছু দিন পরে কোম্পানি থেকে একজন চাপরাসী পুকুরের কাছে একটা হুকুম মেরে দিল। কি আশ্চর্য! একেবারে বাহ্যে করা বন্ধ হয়ে গেল।

“তাই বলছি, হেঁজি-পেঁজি লোক লেকচার দিলে কিছু কাজ হয় না। চাপরাস থাকলে তবে লোকে মানবে। ঈশ্বরের আদেশ না থাকলে লোকশিক্ষা হয় না। যে লোকশিক্ষা দিবে, তার খুব শক্তি চাই। কলকাতায় অনেক হনুমান পুরী আছে — তাদের সঙ্গে তোমায় লড়তে হবে। এরা তো (যারা চারিদিকে সভায় বসে আছে) পাঠ্‌ঠা!

“চৈতন্যদেব অবতার। তিনি যা করে গেলেন তারই কি রয়েছে বল দেখি? আর যে আদেশ পায় নাই, তার লেকচারে কি উপকার হবে?”

[কিরূপে আদেশ পাওয়া যায় ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাই বলছি, ঈশ্বরের পাদপদ্মে মগ্ন হও।

এই কথা বলিয়া ঠাকুর প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া গান গাহিতেছেন:

ডুব্‌ ডুব্‌ ডুব্‌ রূপসাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন।
“এ-সাগরে ডুবলে মরে না — এ যে অমৃতের সাগর।”

[নরেন্দ্রকে শিক্ষা — ঈশ্বর অমৃতের সাগর ]

“আমি নরেন্দ্রকে বলেছিলাম — ঈশ্বর রসের সমুদ্র, তুই এ-সমুদ্রে ডুব দিবি কি না বল। আচ্ছা, মনে কর খুলিতে একখুলি রস রয়েছে আর তুই মাছি হয়েছিস। কোথা বসে রস খাবি বল? নরেন্দ্র বললে, ‘আমি খুলির আড়ায় বসে মুখ বাড়িয়ে খাব! কেন না বেশি দূরে গেলে ডুবে যাব।’ তখন আমি বললাম, বাবা, এ সচ্চিদানন্দ-সাগর — এতে মরণের ভয় নাই, এ-সাগর অমৃতের সাগর। যারা অজ্ঞান তারাই বলে যে, ভক্তি প্রেমের বাড়াবাড়ি করতে নাই। ঈশ্বরপ্রেমের কি বাড়াবাড়ি আছে? তাই তোমায় বলি, সচ্চিদানন্দ-সাগরে মগ্ন হও।

“ঈশ্বরলাভ হলে ভাবনা কি? তখন আদেশও হবে, লোকশিক্ষাও হবে।”

“ওঁ নিরঞ্জনং নিত্যমনন্তরূপং ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ।
ঈশাবতারং পরমেশমীড্যং তং রামকৃষ্ণং শিরসা নমামি।।”

🌷🌷🌷🌷🌷🌾🙏🙏🙏🙏🌾🌷🌷🌷🌷🌷

Vairyagyashatakam(5)

বৈরাগ্য শতকম্।
তৃষ্ণাদুষণম্ – ০৫

অমীষাং প্রাণানাং তুলিতবিসিনীপত্রপয়সাং, কুতে কিং নাম্মাভিবিগলিতবিবেকৈর্ব্যবসিতম্। যদাঢ্যানামগ্রে দ্রবিণমদনিঃসঙ্গমনসাং, কৃতং বীতত্ৰীড়ৈ নিজগুণকথাপাতকমপি ॥ ৫॥

অনিশ্চিত এই জীবন রক্ষার জন্য আমরা ঠিক, ভুল বিচার না করেই আমি সব রকম দুষ্কর্ম্ম করেছি।প্রচলিত ক্ষমতাশালী ব্যক্তির কৃপা লাভের জন্য তাদের সামনে আমার গুণের প্রদর্শন করে তাদের মন জোগাতে চেয়েছি।কিন্তু, তাতেও আমার বিন্দুমাত্র শান্তিলাভ হয়নি।

Vairagya shatakam (4)

তৃষ্ণাদুষণম্-৪

খলালাপাঃ সোঢ়া: কথমপি তদারাধনপরৈঃ, কৃতো বিত্তস্তম্ভপ্রতিহতধিয়ামঞ্জলিরপি, ত্বমাশে মোঘাশে কিমপরমতো নর্তয়সি মাম্‌ ॥ ৪ ॥

অর্থ – আমি আমার স্বার্থসিদ্ধির জন্য কত কুব্যক্তির কত নীচ ভাষণ শুনেছি, এবং তাদের কথা ভুল জেনেও কত কষ্টে নিজের মনের কষ্ট চেপে রেখে উপরে উপরে আনন্দ প্রকাশ করেছি। বিষয়াসক্ত এবং জাগতিক ক্ষমতার নেশায় মত্ত মানুষের সামনে নত ও হাতজোড় করে থেকেছি, কিন্তু এতে আমার বিশেষ কোন লাভ হয় নি।

  • হে ব্যর্থ বিষয়াশক্তি তুমি আমাকে এছাড়া আর কিভাবে নাচাবে?

Vairagya shatakam (2)

উৎখাতং নিষিশংকয়া ক্ষিতিতলং ধ্মাতা গিরের্ধাতবো, নিস্তীর্ণঃ সরিতাং পতি র্ন পতয়ো যত্নেন সন্তোষিতাঃ। মন্ত্রারাধনতৎপরেণ মনসা নীতা: শ্মশানে নিশাং, প্রাপ্ত: কাণবরাটকোহপি ন ময়া তৃষ্ণেধুনা মুঞ্চ মাম্‌ ।। ।।

অর্থ: আমি গুপ্তধন লাভের আশায় কতো কঠিন চেষ্ঠা করেছি বা ছুটেছি। টাকার লোভে, কতো বড়ো বড়ো লক্ষ্য বানিয়ে খেটেছি। জাগতিক সুবিধার জন্য কতো দূরদেশে গিয়েছি, প্রচলিত ক্রিয়া প্রক্রিয়া করেছি। এতো কষ্ট করেও আমার বিষয় পিপাসা মিটলো না। এই বিষয়তৃষ্ণার কাছে অনুরোধ, এবার আমাকে শান্তি দিক।

SWAMI TRILOKYANANDA JI

l

প্রশ্ন:- অষ্টাঙ্গিক মার্গের “সৎ চিন্তা “ব্যাপারটা আসলে কি?

মহারাজ :- চিন্তা মাত্রই অসৎ। সত্য তো সব চিন্তার পার। সৎ চিন্তা অর্থাৎ চিন্তার যত content তা যেন সত্যের দিকে point করে।

সত্য কি? যে চিন্তার আগে রয়েছে। যে চিন্তারও দ্রষ্টা, সে সত্য। যখনই সে অসৎকে ধরে চিন্তায় প্রবেশ করে, চিন্তা অসৎ হয়ে যায়। অসৎ কি? -যা বদলায়। যা সময়ের সাথে একই থাকে না, তা অসৎ। যে এটা জানে অর্থাৎ বুঝেছে, সেই জ্ঞাতা সৎ।

এ জগত এ দুয়ের – দ্বৈতের সমাহার। যতক্ষণ আপনি দেহধারী, এই দ্বৈতের সম্মুখীন হতেই হবে। আপনি দ্বৈতের দ্রষ্টা। যখনই যে কোন দৃশ্যের সাথে আপনি সম্পৃক্ততা বা “দ্রষ্টা-দৃশ্য” relation রাখেন না, আপনাকে সাক্ষী বলা হয়।

Witness, যেমন just যা দেখেছে তাই বলবে, ঠিক- ভুল বিচার করা তার কাজ নয় কিন্তু তার কোন স্বার্থ সম্পর্ক থাকলে সে তা পারবে না, পক্ষ নিয়ে ফেলবে। তাই নিরপেক্ষ কাউকেই এই witness এর কাজ দেওয়া হয়। এমন হয়ে যাওয়াই সৎ। আর তা তখনই সম্ভব, যখন আপনি জগত বা দৃশ্য ও দ্রষ্টার থেকে নিজেকে আলাদা করবেন। দ্রষ্টা, দৃশ্যের সাথে ধারণা জনিত সম্পর্ক না পাতালেই তাকে সাক্ষী বা সৎ বলা হয়।

বাকি দৃশ্য ও দ্রষ্টা দুই- ই অসত্য। কারন একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যা কিছুর উপর নির্ভর তা সত্য নয়।দেখবেন যে বিষয়ে আপনার কোন স্বার্থ নেই, সে বিষয়ে রুচীও নেই, বিষয়টিও আপনার জন্য নেই।

বুদ্ধদেব যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলেছিলেন, তা হাল্কা নয়, অতি সুগভীর। চিন্তা দ্বৈতাত্মক অর্থাৎ অসৎ। তুমি এই চিন্তার সাথে একাত্ম হয়ো না।একদিকে দৃশ্যরুপে চিন্তা, অন্যদিকে দ্রষ্টা রূপে চিন্তা- তুমি সাক্ষী হয়ে যাও। এই স্তরেই মাত্র ব্যক্তি নিরপেক্ষ অর্থাৎ কোন কিছুর অপেক্ষা করে না। যে অপেক্ষা রেখেছে, তাকে কোন না কোন পক্ষ নিতেই হবে।

দ্বৈতই মিথ্যা, তো তার যাবতীয় চিন্তা অসৎ হলো। যে চিন্তা ও বস্তু থেকে কোন অপেক্ষা রাখে না, সে মাত্র সৎ, আর ঐ সৎ এর থেকে যে practical outlet আসবে, যে কর্তব্যবোধ উঠবে, তাই সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, সৎ জীবন, সৎ সংকল্প।

Swami Trilokyananda ji

প্রশ্ন :- “লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, তিন থাকতে নয়”- এর অর্থ কি?

মহারাজ :- এগুলোকে পাশ বলা হয় অর্থাৎ যা জীবকে বেঁধে রাখে। কেন পাশ? এগুলো আপনার ক্ষুদ্রতা বা ব্যক্তিগততাকে enhance করে। কিন্তু, তারও আগে একটি বিষয় আছে – “তিন থাকতে নয়”- যদি বলেন, তবে কি হতে চান? সেটা আগে বলুন। যা হতে এই তিনটি বাধা দিচ্ছে। বেশীরভাগ মানুষ ভুল জীবন বাঁচতে বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যায়। পাপ কর্মে মানুষের ভয় কোথায়? মুখে বলে মিথ্যাকে ঘৃণা করি, কিন্তু কাজে সে মিথ্যাকেই ভালোবাসে।

বলা হয়েছিল জীবনের নিম্নতম কাজে লজ্জা রাখো। মানুষ হয়ে যদি জীবন্মুক্ত না হলে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ না করে ক্ষুদ্র স্বার্থে কাটাচ্ছো, তবে লজ্জাজনক জীবন তোমার। যদি মিথ্যা কর্মে, যা ক্ষতিকর তা করতে ঘৃণা নেই, যদি জীবন ব্যর্থ কর্মে গেল বলে ভয় নেই, তবে তুমি পাশে বাঁধা।

এই প্রবাদটি নির্ভর করবে আপনি ব্যক্তি হিসাবে জীবনকে কিভাবে দেখছেন, তার উপর। যদি সঠিক জীবন কাটান, তবে এই লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, কুল, শীল, মান আপনার গলার মালা হয়ে যাবে। এগুলো থাকবেই থাকবে, যায় না কখনো।আবার যদি ভুল জীবন কাটান, তখন এগুলো গলায় কাল সাপের মতো হয়ে যাবে। তা আপনার জীবনকেও বিষাক্ত করবে ও সমাজকেও।সঠিক অর্থাৎ যে চেতনাগত জীবন কাটাচ্ছে, মুক্ত হচ্ছে ও সমাজে মুক্তি ছড়াচ্ছে, এমন কারোর কাছে অষ্টপাশ, অষ্টভূষণ হয়ে যাবে। যেমন, TV সিরিয়াল এ দেখায়, তীর মারলো, তা গলার হার হয়ে গেল। তেমনি যদি লজ্জা, ঘৃণা, ভয় সঠিক কাজে আসে, যেমন- সত্য বললে লোকে কি বলবে? নিজের ও বাড়ির লোকের অপকর্মে আমাদের ঘৃণা নেই, কারণ স্বার্থ নিহিত। ফেসবুকে আমরা অপকর্মের প্রতিবাদ করতে পারি। জীবনের আসল কাজ হলো না, তাতে ভয় নেই কিন্তু বাড়ির বউকে, office এর boss এর ভয়ে মারছি, তখন এগুলো পাশ বা বুকের তীর ও এর বিপরীত হলে গলার মালা।

প্রকৃতিকে সঠিক ব্যবহার করলে, তাই আত্মার দ্বার খুলবে। আর ভুল ব্যবহার হলে, তাই জীবন ও সমাজের বিনাশ করবে। এখানে প্রকৃতির সঠিক ব্যবহারে লজ্জা, ঘৃণা, ভয় ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। অপব্যবহারে ভরপুর লজ্জাদি রাখুন।

Swami Trilokyananda ji

0

প্রশ্ন :- বিবেক চূড়ামণিতে যে নিরপেক্ষ বুদ্ধির কথা বলা হয়েছে, তা ঠিক বুঝলাম না। যদি দুপক্ষের দোষ দেখতে পাই, তবে নিরপেক্ষ কিভাবে হবো?

মহারাজ:- নিরপেক্ষতার সাথে দুপক্ষের কি relation?
আপনি যখন কোন পক্ষের নন, তখন তাকে নিরপেক্ষ বলে। অপেক্ষা বা কোন আশা আপনি রাখেন না, কোন পক্ষ থেকে।

হতেই পারে দুপক্ষের দোষ বা গুন আপনি বলে দেবেন, যে দুপক্ষেরই দোষ বা গুন আছে – be alert. এটা বলে হাঁটা দেবেন। কারণ, আপনার কিছু তো চাই না! Even আপনি বিচারক হওয়ারও অপেক্ষা রাখেন না। নিরপেক্ষ বুদ্ধি অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্বার্থ, লাভ-অলাভ রহিত বুদ্ধি। আপনি কোন দিকের সাথে ব্যক্তিগত লাভের আশা রাখেন না। তাদের অবস্থিতি আপনার আন্তরিক শান্তিকে যখন ব্যাহত বা enrich করে না, তখন মাত্র আপনি অপেক্ষা রহিত হতে পারবেন।

এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বিবেকী হয়ে, সত্যের পক্ষে। দু-পক্ষ বা দ্বৈতের সাক্ষীমাত্র যা, তা সত্য। যখনই আপনি সাক্ষী, বিবেকে তখনই একমাত্র প্রতিষ্ঠিত। আপনার মধ্যে অপেক্ষা থাকলে কখনোও আপনি বিবেকী নন।

তাই বিবেক চূড়ামণিতে বলছে, অপেক্ষারহিত হও। কারণ কেউ তোমাকে তা দিতে পারে না, যা তোমার really চাই। তা যে তোমার ভিতরেই আছে! আবরণ সরাতে যে কোন পক্ষ নেওয়া ছাড়ো।আমরা যা বস্তুগত সুবিধার পক্ষ নিই ও হিতকর হলেও যা মজাদার বা সুবিধা না দেয়, তার বিরোধে দাঁড়াই। এ দুয়ের হতেই অপেক্ষা রহিত হতে হবে।

🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺
Swami Trilokyananda ji 🙏

SWAMI TRILOKYANANDA JI

প্রশ্ন :- জ্ঞানী কে? বিজ্ঞানী কে?

মহারাজ :- যে জানে বা বুঝেছে সে জ্ঞানী। আর যে জীবনে ঢেলেছে সে বিজ্ঞানী।আপনি physics এর theory জানেন- তো আপনি জ্ঞানী।

সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানই জানে না। তাই অজ্ঞানী বলে। সে জানে না জলের অভ্যন্তরে কি আছে? Material property কি? একজন ছাত্র জানে ও ঐ ছাত্র যদি ভবিষ্যতে research করে, ও lab এ জল নিয়ে ভেঙ্গে দেখে ও এর উপর thesis করে সমাজের কাজে লাগায়, আবিস্কার করে, তবে সে বিজ্ঞানী। জ্ঞানী জানে কিন্তু কাজে লাগাতে সাহস নাও করতে পারে। তাই বলে,”পুস্তকস্থ বিদ্যা”। সে যদি জীবনে implement করে সেই বিজ্ঞানী হয়ে যাবে।

বিশেষভাবে জানা অর্থাৎ আমি কে? জগত কি? গুরুমুখে, শাস্ত্রমুখে শুনলেন, বুঝলেন অথচ আচরণ করলেন না।”মানে, কিন্তু ” করে জীবন কাটিয়ে দিলেন।তবে কিন্তু, এটা জেনে রাখুন আপনি জ্ঞানীও নন, বিজ্ঞানীও নন। একে বলে কপটতা। জ্ঞান যদি জীবনে আসে, সত্য সত্যই আসে। তার ফলাফলই বিজ্ঞান। যদি জীবনে implement করতে সাহস করছেন না, তবে জানবেন, যা জেনেছেন, তা সর্বাঙ্গীণ নয় বা আপনার পাত্রতা নেই। জ্ঞান, যথার্থতা এমনই প্রজ্ঞাযুক্ত যে তার জীবনে এসে কোনমতে নিষ্ক্রিয় থাকবেই না।

যেমন, বিষ- তা রক্তে রক্তে, শিরায়, শিরায় পৌঁছবেই।তেমনি সত্য অমৃতের মতো, জীবনে এসে মিথ্যার বিষকে কাটবেই কাটবে। যদি না কাটে, তবে জানবেন সেটা জ্ঞান নয়। আপনার মিথ্যা অহংকারের মুকুটের আরেকটা পালক মাত্র। যে বুঝেছে, তাকে করতে হবে।পরার্থে করতে হবে। যে জ্ঞান পেয়েছে, তাকে ঐ সুধা নিজের ও অন্যের জীবনে ছড়াতেই হবে। ও সব কথা বিশ্বাসই করবেন না, ” কিছু চাই না”, “নিজের মতো থাকি”- ” কোন বাসনা নেই “, ” সাতে পাঁচে থাকি না” – এসব বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তামসিকতা ও মিথ্যা। জীবন মানে প্রবাহ; যে প্রবাহিত হচ্ছে না, সে নিশ্চয়ই জীবনের বিরোধে আছে।

Design a site like this with WordPress.com
Get started