lesson from Swami Yatiswaranandaji

মনশান্তরাখার_পদ্ধতি

~~~

স্বামী যতীশ্বরানন্দ :—

চঞ্চল মনকে নিয়ন্ত্রণে এনে একমুখী করা সবচেয়ে দুরুহ ব্যাপার ৷ ছাত্রাবস্থায় আমাদেরই একজন স্বামী ব্রহ্মানন্দের নিকট অনুযোগ করে, “আমার মন এখনো চঞ্চল । কেমন করে তা শান্ত করা যায় ? মনে হয় এজন্য আমার সকল সংগ্রামই ব্যর্থ হয়েছে । এখন এ সকল আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে ৷”

উত্তরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেন : “এতে দুঃখ করার কোন কারণ নেই ৷ ধ্যানের ফল অবশ্যম্ভাবী আর যদি ভক্তি ও বিশ্বাস সহকারে জপ ধ্যান কর তবে ফল লাভ হবেই ৷

সবচেয়ে সহজতম ধ্যান, যেমন কোন দেবতার নাম উচ্চারণ করার অভ্যাসও যদি নিয়মিত করতে পার তবে নিশ্চয়ই মনে শান্তি পাবে ৷

প্রাথমিক পর্যায়ে ধ্যান করা যেন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করা ৷ অশান্ত মনকে সংযত করে ইষ্টের পায়ে লগ্ন করা প্রচন্ড আয়াসসাধ্য ৷ প্রথম প্রথম সতর্ক থেকো যেন ধ্যান করতে গিয়ে মস্তিষ্কের উপর বেশি চাপ না পরে ।

নিয়মিত অভ্যাসে ক্রমে ক্রমে ধ্যানের মাত্রা দীর্ঘ করতে পারলে মনের স্থৈর্য আসে এবং তখন বেশি সময় ধ্যান করলেও ক্লান্তি বোধ হয় না ৷ এতে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং গভীর নিদ্রার পর দেহ ও মনে যেমন সাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে সেই রকম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হবে । ক্রমে গভীর আনন্দের অনুভূতি লাভ করবে ৷

দেহ অসুস্থ হলে মনেরও বিশৃঙ্খলা ঘটে ৷ সুতরাং শরীর সুস্থ রাখার জন্য পথ্য গ্রহণে বিশেষ সতর্ক হওয়া দরকার ৷ ধ্যানের জন্য মনের একাগ্রতা আবশ্যক ৷ অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করলে মনের জড়তা আসে ৷ মানসিক স্থৈর্য বজায় রাখতে সবরকম আবেগ বা আসক্তিকে সংযত রাখবে ৷ ধ্যান না করলে মনকে স্ববশে রাখতে পারবে না, আর মনকে স্ববশে না রাখলে ধ্যান করাও হয়ে উঠবে না ৷

যদি মনে কর প্রথমে মনকে বশে আনার কৌশল আয়ত্ত করি, পরে ধ্যান অভ্যাস করব তবে অধ্যাত্ম জীবনের পথও খুঁজে পাবে না ৷ মনকে বশে আনা ও ধ্যান করা দুটো কাজই এক সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে ৷ সুতরাং মন সংযত কর আর ধ্যান করতে থাক ৷”

Prabrajika Mokshya Prana Mataji s letter

প্রব্রাজিকা মোক্ষপ্রাণা মাতাজীর পত্রের কিছু অংশ :~
~~~~~~~~

তোমরা প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর শ্রীশ্রীঠাকুর-মায়ের প্রতি ভালোবাসা অন্তরে অনুভব করতে পারছ — এটি তাঁদেরই কৃপা ৷

মনের উন্নতি বিধানই তো সব সাধনার লক্ষ্য ৷ মন পবিত্র, উদার না হলে ভগবৎ-কৃপা ধারণা করা অসম্ভব ৷ আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া তাঁর কৃপা ব্যতীত হয় না ৷

বুঝি তাঁর কৃপা, তাঁর মহিমা, তাঁর মাধুর্যের অন্ত নেই ! তিনি যে কীভাবে তাঁর সন্তানদের আকৃষ্ট করেন তা আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগম্য ৷

আধ্যাত্মিক পথ অত্যন্ত দুর্গম ও দুরূহ ৷ এইজন্যই শাস্ত্রে বলা হয়েছে — ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া ৷’

তোমরা নিজ নিজ অধিকার অনুযায়ী ওই পথে এগিয়ে চলার চেষ্টা করো ৷ তোমরা যে যেভাবে এই পথ অবলম্বন করে চলছ বা এরসঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছ, ভালো-মন্দ, হাস্য-পরিহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, মনেতে নানা সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামেই তো পথ চলছ ৷ অর্থাৎ মনে অসদ্ভাব বা মিথ্যা ব্যবহার তো ঠাঁই পায়নি ৷ তাঁর নামেই ওই পথে আছ ৷ সুতরাং তোমরা যাই করো না কেন, তিনি কিন্তু তোমাদের হাত ধরেই আছেন — এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৷ জানি না, তোমরা তা বিশ্বাস কর কিনা ৷ তিনি তোমাদের হাত ধরে ধরে অগ্রসর করাচ্ছেন ৷

কথামৃতের যে-কোনও জায়গা পড়লে বা শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনীর যে-কোনও অংশ পাঠ করলেই বোঝা যায় যে এই মানুষটির মধ্যে কোনও ভেজাল ছিল না ৷ একেবারে খাঁটি চরিত্র ৷ নিজে যেভাবে চলতেন আমাদের কাছ থেকেও তিনি তাই আশা করেন, আমরাও যেন সে ভাবের হই অর্থাৎ খাঁটি চরিত্রের হই ৷ সেটি হওয়া সাংসারিক জীবনে বড় কঠিন, বড় দুঃসাধ্য ৷ কিন্তু কথাটা তোমরা ভালো করে চিন্তা করে দেখো ৷ তিনি খাঁটি ছিলেন, আমরা যেন খাঁটি হই — তাই তিনি চাইছেন ৷ এই সবগুলি জড়িয়ে ১লা জানুয়ারি, কল্পতরু দিবসে ভাবের আতিশয্যে শুধু বলেছিলেন — “তোমাদের চৈতন্য হোক” অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে শুদ্ধচৈতন্য জাগ্রত হোক ৷ তোমরা ভগবানের ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে যাও ৷ নিজ নিজ জীবনে সার্থক ও সফল হও ৷ তোমাদের মানবজীবন পরিপূর্ণতা লাভ করুক ৷

Swami Yatiswaranandaji ‘s Smirti Katha

স্বামী যতীশ্বরানন্দের পুণ্যস্মৃতি :~
~~~~

প্রব্রাজিকা সারদাপ্রাণা :—

একবার ভগবৎকৃপা প্রসঙ্গে পুজ্যপাদ স্বামী যতীশ্বরানন্দ মহারাজ বলেন, “ঈশ্বরের কৃপা, তাঁর করুণা নানা রূপে নানাভাবে জীবনে আসে ৷ পুজ্যপাদ রাজা মহারাজ আমাদের বলতেন, ‘বাবা, তোরা গুরুর কৃপা পেয়েছিস, ঈশ্বরের কৃপা লাভ করেছিস, এখন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় যাতে সেই চেষ্টা কর ৷ তোদের জীবনে মহাপুরুষ-সঙ্গ অনেক হয়েছে, এখন সংযম ও পুরুষকারকে আশ্রয় করে নিজের মনকে জয় করার সংকল্প নে ৷”

“মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব, মহাপুরুষসংশ্রয় দুর্লভ — এ অতি সত্য কথা ৷ কিন্তু এই তিন সহায় যথেষ্ট নয় ৷ নিজের মনের দয়া চাই — যে-মন অলস, হতোদ্যম না হয়ে সর্বদা ঈশ্বরলাভের জন্য যত্নশীল হবে ৷”

কোনও এক ভক্তকে উনি চিঠিতে লিখেছিলেন, “যদি তুমি চেষ্টা করতে গিয়ে বারে বারে বিফল হও — তবু আমি তোমায় একটাই পরামর্শ দেব, আবার চেষ্টা করো ৷ চেষ্টা ছেড়ো না ৷”

“সংগ্রাম চাই, সংগ্রাম ৷ তখন তো তাঁর করুণার ধারা নামবে ৷ যারা উদ্যোগী, ভগবান তাদেরই চিরসহায় ৷ মানুষ যখন চেষ্টার শেষ সীমায় পৌঁছয় তখন ভগবান সেই বিপন্ন, সংগ্রামী মানুষটার পাশে এসে দাঁড়ান ৷ ঈশ্বরের কৃপা পুরুষকারের রুপ ধরে প্রকাশ পায় — অনবরত চেষ্টায় নিজের মনই শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয় ৷”

“জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন বা একাত্মতালাভ — ঈশ্বরকৃপার সেটাই শ্রেষ্ঠ পরিণাম ৷ ঈশ্বরের কৃপাতেই এই সর্বোচ্চ সীমায় মানুষ পৌঁছতে পারে ৷”

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

বহু জন্ম সাধনা না করিলে, সাধন করিবার শক্তিবৃদ্ধি হয় না ৷ তাই যাঁহারা পূর্ব-পূর্ব জন্মে সাধন করিয়াছিলেন, শেষ জন্মে তাঁহাদের সাধনে এত উৎসাহ বাড়িয়া যায় যে, তাঁহারা এই দেহ থাকিতেই মুক্তিলাভ করেন ৷ তাহাদিগকে বলে জীবন্মুক্ত ৷ Free while living.

যাঁহারা পূর্ব-পূর্ব জন্মে সাধন করিয়াছিলেন, কিন্তু সাধনে তীব্র অনুরাগ এখনও বিকশিত হয় নাই, তাঁহারা যদি নিরুৎসাহ না হইয়া সাধনে প্রবৃত্ত থাকেন, তবে মৃত্যুকালে তাঁহাদের মুক্তিলাভের তীব্র ইচ্ছা হেতু তাঁহারা মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন আর জন্মগ্রহণ করেন না ৷ তাঁহারা এই জগতে আর ফিরিয়া আসেন না বলিয়া তাঁহাদের বলে অনাগামী ৷

সাধকগণের মধ্যে যাঁহারা নিরন্তর সাধনা করিতে পারেন না, উৎসাহ থাকিলেও কোন একটা দারুণ বাধা হেতু মৃত্যুকালে মুক্তির ভাব মনে উঠিতে পারে না — তাঁহাদের আর একবার মাত্র জন্মগ্রহণ করিতে হয় ৷ সকৃত — একবার ৷ তাঁহাদের বলে সকৃদাগামী ৷

যাঁহারা কোন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত হন এবং কিছুটা স্বেচ্ছায়, কিছুটা সামাজিক নিয়ম পালনের জন্য ভগবৎচিন্তা করেন, তাঁহাদের অবস্থা ঠিক যেন এক টুকরা কাঠকে নদীর জলে ফেলিয়া দিলে, বহুদিন এখানে ওখানে ঠেকিয়া ঠেকিয়া অনেকদিন পর সাগরে পতিত হয়, ঠিক সেইরূপ ৷ তাঁহাদের মুক্তি হইবেই — তবে কবে হইবে, কতজন্ম পরে হইবে, তাহার কোন ঠিক নাই ৷ সেইজন্য তাহাদিগকে বলে স্রোতাপন্ন ৷

Swami Premeshanandaji’s collection

প্রশ্ন : মহারাজ, আপনি পুরুষকারের ওপর জোর দেন। অথচ অন্যান্য মহারাজ কৃপার ওপর জোর দেন। বলেন—ঠাকুরের কৃপা, মায়ের কৃপা না হলে হবে না।

( প্রেমেশ) মহারাজ : আসল হলো পুরুষকার—God helps those who help themselves. যতই নিজের অজ্ঞান-আবরণ খুলবে, ততই সে সমষ্টি- চৈতন্যের আকর্ষণ অনুভব করবে এবং সেই আকর্ষণকেই আমরা ‘কৃপা’ বলি। তোমাকে কিছু তো করতে হবে। এই প্রসঙ্গে কর্ম সম্বন্ধে একটু বলি। কর্ম তো তিন প্রকার জান? সঞ্চিত, ক্রিয়মাণ, প্রারব্ধ। একজনের ব্যাঙ্কে ১০০০ টাকা (সঞ্চিত) আছে। সে একটা পুকুর কাটাবে বলে ৩০০ টাকা (প্রারব্ধ) তুলল। তার মধ্যে ২০০ টাকা ক্রিয়মাণ। আবার ক্রিয়মাণের ফল সঞ্চিততে জমা হলো। সুতরাং, কর্মের গতি eternal। তাই ঈশ্বরে অনুরাগ বাতিরেকে রেহাই নেই। ঈশ্বরকে না ধরলে এই চক্র থেকে রেহাই নেই।

-স্বামী প্রেমেশানন্দ মহারাজ

গ্রন্থ : সারগাছির স্মৃতি
সঙ্কলক ও সম্পাদক : স্বামী সুহিতানন্দ
পৃ.: ৩০

জয় মহামাঈকী জয়
জয় ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব কী জয়
জয় স্বামীজি মহারাজজী কী জয়

Swami Premeshanandaji’s collection

তুমি গুরুর ব্যাপার সম্বন্ধে এই ভুল করিতেছ যে তাঁহাকে ব্যক্তি মনে করিতেছ। এই জীবনে যাহা জানিলে তাহাই continue করিবে ও নানা শক্তির সাহায্যে বিকাশ প্রাপ্ত হইবে। গুরু বলিতে সেই ঐশী শক্তি বুঝায় যাহা অ, আ, ক, খ, কড়াকিয়া হইতে ব্ৰহ্মতত্ত্ব পর্যন্ত শিক্ষা দেয়। যাহার নিকটই কিছু শিখা যায় সেই শুরু। তুমি বিজ্ঞানের শিক্ষা যে প্রকার লাভ করিয়াছ — ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষাও সেইভাবে লাভ করিবে। … আমি ভালো আছি। আমার স্নেহ ভালবাসা জানিবে।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

মন কেন তাঁকে চাহে না—যারা চিটে গুড়ের পানা নিয়াই ব্যস্ত তাদের হঠাৎ এক আধ দিন মিশ্রির পানা তেমন প্রিয় বোধ হয় না। “অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।” অভ্যাস চাই। যদি সত্যই প্রিয় বোধ হইত তবে আমরা কেন তাঁর চিন্তা নিয়া থাকি না? দেখো নাই সুন্দর একটা মানুষ দেখিলে তাঁর কথা কিছুতেই ভুলা যায় না। ঠিক ঠিক প্রিয় বুদ্ধি হলে এই যে আমার মধ্যে আমির ভিতরে নিকটতম অনন্ত আনন্দ সমুদ্র, তাহা পাইতে কি কোনও চেষ্টার প্রয়োজন হয়? চাই না তাই পাই না। সময় না হলে পাওয়া যায় না। … সময় না হলে কিছুই হয় না। সময়কে এগিয়ে আনার জন্যই যোগ, কিছু কিছু করিয়া অভ্যাস করিতে হয়—“তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।”

চাকরি-বাকরি যা করিবার করিয়া ফেল। তারপর স্থির হইলে আরও গবেষণা করিবে। এখন কাজকর্মের ব্যবস্থা কর।…

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

যখন যে অবস্থায় পড়া যায়, সেখানকার সাথে খাপ খাওয়াইয়া লওয়াই কর্তব্য। একটা রুটিন করিয়া খুব হুঁশিয়ার ভাবে চলিলে তোমার জীবনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে পারে। জীবনটাকে সমাজের উন্নতির কার্যোপযোগী করিয়া তুলা সর্বাগ্রে কর্তব্য। তারপর নিষ্কাম ভাবে সেই কার্য সারাজীবন করিলে মুক্তি পর্যন্ত লাভ হইবে। রুটিন করিয়া প্রতিদিন সার্থক করিয়া তুল, প্রতি ক্ষণ সার্থক করিয়া তুল। সম্মুখে অনন্ত কাল আছে। দেহ কতবার জন্মেছে মরেছে। এইবার যদি শ্রীরামকৃষ্ণ-চরণে জীবনের সকল কার্য, সকল আশা আকাঙ্ক্ষা সমর্পণ করিতে পারো, তবে সকল দুঃখ চিরকালের জন্য দূর হইবেই হইবে।

সম্মুখে শ্রীরামকৃষ্ণ-আদর্শ স্থাপন করিয়া জীবনটাকে এই ছাঁচে গড়িয়া তুলিতে হইবে। তাহা সহজ নহে এবং কঠিনও নহে। ….

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

গীতার ধ্যান আর কিছুই নহে, কেবল নিজের উপর সব কথার প্রয়োগ মাত্র। অষ্টাদশ অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকটি গভীর ভাবে চিন্তা করো—আমি কাম্য কর্ম ন্যাস করিতে পারি নাই অর্থাৎ ছাড়িয়া দেই নাই, এখন ছাড়িয়া দেওয়া সম্ভব নহে। অতএব যত কিছু কাম্য কর্ম করিব নিজের জন্য না করিয়া পরিবারের সকলের উন্নতির জন্য করিব অথবা আমি ভগবানের যন্ত্ররূপে চালিত হইয়া ঘটনাচক্রে পড়িয়া এইসব কার্য করিতেছি মাত্র—ইহাতে আমার নিজের কোন… কামনা নাই, এইরূপ ভাব। কর্মসন্ন্যাস ও ফলসন্ন্যাস এই দুইটি ভাব চিন্তা করাই ধ্যান। কোনও কর্ম কর্তব্যরূপে তোমার নিকট উপস্থিত হইলে তাহা নিষ্কাম ভাবে করিব—এই ভাবগুলি একান্ত নিজের করিয়া লওয়াই ধ্যান। ….

সহসা ব্রহ্মচারী হওয়া যায় না। ‘সাধু সাজা’ সহজ কিন্তু সাধু হওয়া বড়ো কঠিন। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ভিতরে আনিতে পারো কি না তাহা দেখো। ….

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

…মন বুঝি একটু অপছন্দ কিছু হইলেই চটিয়া আগুন হয় ? তবে তো তোমার বড় কষ্ট হে বিবেক ! বিবেক কথাটার মানেই এই যে, মন্দ হইতে ভাল বাছিয়া বাহির করা ৷ তাই কর ও সুখী হও ।

তুমি যেসব সমস্যার সমাধান চাও, আমরা সেই সম্বন্ধেই যুগ যুগান্তর ধরিয়া গবেষণা করিতেছি — গুরুপরম্পরায় ৷ ১ম এই জগতের তত্ত্ব জানেন ব্রহ্মা, তারপর তাঁর শিষ্য হইতে চলিতে চলিতে তোতাপুরীর শিষ্য রামকৃষ্ণ জানেন ; তাঁর শিষ্যদের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করিয়া আমরা অনেক দূর পর্যন্ত জানিয়াছি ৷ আমরা যাহা যাহা জানিয়াছি তাহা জানাইবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল হইয়া ফিরি ! কত লোকের যে খোসামোদ করি ! কিন্তু কেহ যে জানিতে চায় না হে বিবেক !

এই জগতে দুইটি দল আছে । একটি চেতন ও একটি অচেতন ৷ উভয়ে ফুটবল খেলিতেছে ৷ যখন জড় জয়ী হয়, তখন জগতে অন্যায় পাপ প্রভৃতি দেখা যায়, যখন চৈতন্য জিতে, তখন ভাল ভাল ভাব প্রকাশ হয় ৷ ধর্ম সাধনা, নৈতিক সাধনা, রাজশাসন প্রভৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য জড়কে দাবাইয়া চৈতন্যকে স্বতন্ত্র স্বাধীন করা ৷ ঐ যে মাড়োয়ারি পুণ্য করিতে পাপ করে, তাহাতে দেখা যাইতেছে ‘চৈতন্যের’, জড়ের হাতে পরাজয় ! পশুপ্রকৃতি দেবপ্রকৃতিকে দাবাইয়া দিল ৷ ঠিক যেন একটি খেলা ৷ ইহা ব্যক্তির জীবনে যেমন প্রকাশ পায়, জাতির জীবনেও প্রকটিত হয় ৷ পশ্চিমে জড় ( রজোগুণরূপে ) রাজত্ব করিতেছে ৷ এদেশে জড়, তমোভাবে, দেশের কর্তা ৷ জড়ের তিন রূপ — সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ ৷ আমরা চেষ্টা করিতেছি, জড় জয়ী হইলেও যেন তার সত্ত্ব ভাবটা জয়ী হয় ; তার নাম “রামকৃষ্ণ মিশন” ৷

গীতা ১৮শ অধ্যায় ৬১ নং শ্লোক দ্রষ্টব্য — ঈশ্বর সর্বভূতের হৃদয়ে থাকিয়া কলের পুতুলের মতো তাহাকে নাচাইতেছেন ৷ তিনি সর্বময় কর্তা ৷

ব্রহ্মা জগৎ রূপে নিজে সাজিয়াছেন ৷ তিনিই সব হইয়াছেন, সব করিতেছেন ৷ মুনি ঋষিরা, ঠাকুর স্বামীজী প্রভৃতি সকলে দেখিয়াছেন যে জগৎ চৈতন্যময়, ব্রহ্মময় ৷ দেহের ভিতর দিয়া জগৎ এইরূপ দেখা যায় ৷ দেহ খুলিয়া নিজের চোখে দেখিলে ( যেমন লোকে চশমা খুলিয়া নিজচক্ষে কখনো কখনো দেখে ) জগৎ ব্রহ্মময় হয় ৷ ঐ যে শিব কালী প্রভৃতির কপালে একটি চোখ থাকে, তাহাই “জ্ঞান-দৃষ্টি” ৷ জ্ঞান হইলে দেখা যায় — জগৎ ব্রহ্মময় ৷ আবার দেহের ভিতর দিয়া দেখিলে জগৎ আমরা যেমন দেখি তেমনই দেখা যায় । স্বামীজী জ্ঞান-দৃষ্টিতে জগৎ ব্রম্মময় দেখিতে চাহিতেন ; কিন্তু ঠাকুর তাঁহার সেই দৃষ্টি বন্ধ করিয়া জগৎকে মানব দৃষ্টিতে দেখিতে তাঁকে বাধ্য করেন ৷ জগতের বাহ্য বীভৎস রুপ দেখিয়াই মহাপুরুষদের মনে দয়া হয় এবং জীবকে উপদেশ দিয়া শিক্ষা দেন ৷

এই জগৎ যাহারা পছন্দ করে না, তাহাদের উচিত জগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হওয়া ৷ যাহারা জগৎ ভালবাসে তাহারা এই জগতের সব নোংরামি সহ্য করিয়াই এখানে থাকে । আমি বহরমপুর ভালবাসি, তাই এখানে আসিয়াছি, এখানে আমার কাছে দিনরাত গাড়ির বিভৎস চিৎকার, লাউডস্পিকারের গর্জন কানে, নাকে ড্রেইন ও পায়খানার গন্ধ, চোখে ভোগীদের বিলাস সাজ-সজ্জা দারুন কষ্টকর হইলেও অম্লান বদনে সহ্য করিয়া যাইতেছি — প্রিয়জনের মুখ দেখিয়া ও ‘ভক্ত’ দত্ত, উপাদেয়, রসনা-বিনোদন ভোজ্য পাইয়া !

ওগো, একরাশি জড় উদ্বেলিত, উচ্ছসিত, উৎক্ষিপ্ত হইতেছে — পাছে থাকিয়া দুষ্টু ছোঁড়াটা হিঃ হিঃ করিয়া হাসিতেছে ৷ এ যে ক্ষ্যাপা মায়ের খেলা, যার ভাবে ভুবন বিভোলা ৷ সেই গান জান, “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আন মনে ৷”

গীতা ২য় অধ্যায় ১৫ নং শ্লোকটা বারবার পড় ৷ এই জগৎ কত বৎসর যাবৎ চলিতেছে, হে বিবেক ? আর কতদিন চলিবে ? তুমি আর কতটুকু দেখেছ এবং সারা জীবনে দেখিতে পারিবে ? রাম বল ৷ এর কি অন্ত আছে ? অন্তরে হরি আছেন ; তাকে দেখ ৷

আমি তো চাই, এই বিশ্বরহস্য, তুমি বুঝিবার চেষ্টা কর ৷ তাহাই আমরা যুগান্তর ধরিয়া চর্চা করিয়াছি ৷ পশ্চিমীরা বাহিরটা ‘বেশ বুঝে’, আমরা ভেতরটা ‘সব বুঝি’ ।

( স্বামী প্রভানন্দজীকে লিখিত )

Design a site like this with WordPress.com
Get started