Swami Sarvapriyanandaji s spiritual lesson.

সংবেদনশীল_আত্মচেতনা ( ১ )

~~~~~

স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দ :—

♦️ অধ্যাত্মপথে নিজেকে উন্নীত করতে সচেষ্ট হলেও এই যে চারপাশে মানুষের এত কষ্ট, শোক — এসব দেখে খুব বিহ্বল, অবসন্ন লাগে, বিব্রত হয়ে পড়ি । নিজের পাশাপাশি সকলকে কী করে ভালো রাখব ?

⚜️ সত্যি বলতে, এমনটিই হওয়া উচিত ৷ একজন সংবেদনশীল মানুষ এভাবে ভাবতে বাধ্য ৷ মানুষ যদি অন্যের কষ্ট অনুভব না-ই করল, তাহলে সে তো পাষাণহৃদয় ! কিন্তু কী জানেন তো, আপনাকে যেমন অনুভবী হতে হবে, তেমনই হতে হবে বাস্তববাদী ৷

অন্যের দুঃখে আমরা দুঃখী অবশ্যই হব, সে খুবই ভালো কথা ৷ কিন্তু একইসঙ্গে, তাতে বিহ্বল হলে চলবে না ৷ আমার নিজের অধ্যাত্মপথে আমাকে সবসময় প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে ৷ আমরা ব্যক্তিগত শোকতাপ থেকে উত্তীর্ণ হই কীভাবে ? এই আধ্যাত্মিকতার সাহায্যেই তো !

♦️ কিন্তু নিজের আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে অন্যের যন্ত্রণার উপশম কি সম্ভব ?

⚜️ অবশ্যই সম্ভব ৷ আপনি যেভাবে আপনার চারপাশ দেখতে অভ্যস্ত, তেমন একটি পথকেই ধরুন না ! যদি একজন কর্মযোগীর কথাই বলি, তাঁর ভাবনা সবসময় কেমন জানেন ? মানুষের সেবা করাই তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য ৷ তাঁর চারপাশের সব মানুষের সেবায়, দুঃখকষ্ট দূর করার কাজে তিনি এমন নিমগ্ন থাকেন যে, কখনো যদি-বা তাঁর ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা এসে উপস্থিত হলো — কেউ খারাপ ব্যবহার করল বা আর্থিক অনটন — সেসবকে তাঁর বড় তুচ্ছ মনে হয় ৷

এমনই হয়, দেখবেন, যখন অনেককে ভালো রাখার গুরুদায়িত্ব আপনার কাঁধে, যখন আপনি তাঁদের পরিস্থিতি, প্রতিকূলতার সঙ্গে একাত্মবোধ করছেন, তখন আপনার ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি গৌণ হয়ে ওঠে ৷ উলটোদিকে আবার এমন অনেক মানুষও আছেন, যাঁরা অধ্যাত্মপথে এসেও পরার্থকর্মে নিজেদের নিয়োজিত না করার ফলে নিঃস্বার্থ হওয়ার বদলে আরও বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠেন । নিষ্কাম কাজের মধ্যে না থাকলে, সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে একা থাকলে মন বড় সংকীর্ণ হয়ে যায় ; এই ক্ষুদ্র দেহবুদ্ধি, নিজস্ব সমস্যাই তখন সর্বস্ব হয়ে ওঠে ৷ ( চলবে )

Swami Premeshanandaji’s collection

মানুষ মাত্রেরই একটা তথ্য জানা একান্ত কর্তব্য (তৃতীয় ভাগ)

তুমি সংসারে সুখে থাকিবার জন্য সাধু হইলে, না সংসার ছাড়িয়া চিরশান্তির পথ খুঁজিতে বাহির হইয়াছ? যদি সংসার ছাড়িতে চাও—তবে এর মুখপানে, ওর মুখপানে তাকাও কেন? তোমার ছেলের কলেরা হইয়াছে, ডাক্তার আনিতে ছুটিয়া বাড়ির বাহিরে গেলে, পথে একটা লোক তোমায় গালাগাল করিতে লাগিল। তুমি কি করিবে তখন? ঐ লোকটা তোমাকে অপমানিত করিল—সহিয়া থাকিবে? না—ডাক্তারের জন্য ছুটিবে?

মোট কথা—নূতন স্কুলে ভর্তি হইয়াছ, উপরের শ্রেণীর ছাত্রেরা কান ডলিতে আসিবে, মাস্টাররা বেত মারিবে। বাড়ি গিয়া বসিয়া থাকিলে পড়া হয় না, স্কুলেও এই উপদ্রব। কি করা যায় বলো? …..

(১) যারা ভগবানের চিন্তায় তন্ময় –

(২) যারা সব দুঃখ ‘স্থির চিত্তে’ সহিতে পারে এই দুইজন ছাড়া কেহই জগতে সুখী নহে গো, সুখী নহে।

“শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপা” ছাড়া আমাদের যে কিছু করিবার সাধ্য নাই, বাবা!

বাহিরের দিকে না তাকাইয়া—নিজের দিকে তাকাও। ঠাকুর আছেন তোমার বুকের ভিতর।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

From swami Turiyanandaji s letters

শরীর থাকিলেই সুখ-দুখ লাগিয়া থাকিবে–“ন বৈ সশরীরস্য প্রিয়াপ্রিয়য়োরপহতিরস্তি।” ( সশরীর ব্যক্তির অর্থাৎ যার দেহে আত্মবুদ্ধি আছে এমন ব্যক্তির প্রিয় ও অপ্রিয় অর্থাৎ ভালোমন্দের হাত হতে অব্যাহতি নেই — ছান্দোগ্য উপনিষদ) ইহা বেদবাক্য। তবে শরীর শরীর করে জীবনকাটানও ভাল নহে, ইহাও বেদই আজ্ঞা করিয়াছেন। “অশরীরং বাব সন্তং ন প্রিয়াপ্রিয়ে স্পৃশতঃ।” অর্থাৎ এই শরীরের মধ্যেই আত্মা অশরীরী আছেন, তাঁহাকে প্রিয় অপ্রিয় কিছুই স্পর্শ করিতে পারে না। আমি শরীর — এই ভাবনা করিয়াই তো সুখে-দুঃখে জর্জরীভূত। আমি শরীর নহি, আমি অশরীরী আত্মা — ভাবনা করিয়া সখে দুঃখের পারে যাইবার যত্ন করিতে চেষ্টা করা মন্দ নয়। ইহাতে অনেক কষ্টের লাঘব হয়, সন্দেহ নাই।

এ সংসারে সমস্তই চিন্তার ফল। যে যেরূপ চিন্তা করে, সে সেইরূপ হয়। সর্বদা শরীর-ভাবনার চেয়ে অন্ততঃ সময় সময় অশরীর চিন্তা করা অভ্যাস করিলে বহু কল্যাণ সাধিত হইবার সম্ভাবনা। প্রভু যীশ, বলিয়াছেন “He that has, to him shall be given. He that has not, from him shall be taken even what he has ” – অর্থাৎ যাহার আছে তাহাকে আরও দেওয়া হইবে। আর যাহার নাই তাহার কাছ থেকে যাহা আছে তাহাও কাড়িয়া লওয়া হইবে। ভারি সত্য কথা। আমাদের ঠাকুরও বলিতেন, “যে সর্বদা বলে “আমার কিছু, হলো না’, ‘আমি পাপী’ ইত্যাদি, তাহার কিছু হয়ও না এবং সে পাপীই হইয়া যায়।”

অতএব হতাশ হইতে হইবে না বরং এই ভাব আনিবার চেষ্টাই করিতে হইবে যে, আমি ভগবানের নাম করিতেছি আমার ভয় কি? তাঁর কৃপায় আমার সকল -বালাই চলিয়া যাইবে। ‘জয় মা কালী’ বলে তাল ঠুকে তাঁর নাম, তাঁর চিন্তা করতে লেগে যাবে। তা হলে বল আসবে। পড়ে থাকলে আরও পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। একবার তেড়ে-ফাড়ে উঠতে পারলে আর পড়ে থাকতে ইচ্ছা হয় না, তখন আবার বেড়াতে ইচ্ছে হয় ও জোরও আসে।

-স্বামী তুরীয়ানন্দ

গ্রন্থ : স্বামী তুরীয়ানন্দের পত্র
পত্র : ৭৫
পৃ.: ৭৮

Swami Premeshanandaji’s collection

মানুষ মাত্রেরই একটা তথ্য জানা একান্ত কর্তব্য (দ্বিতীয় ভাগ)

২য় তাপ—মশা, মাছি, সর্প, ব্যাঘ্র, রোগের বীজাণু, চোর, ডাকাত, রাজা, অত্যাচারী শাসক, ‘বদরাগী-অহঙ্কারী-লোভী-সহবাসী’। কত বলিব, জগতের সকল জীবকে যেন আমায় দুঃখ দিবার জন্যই সৃষ্টি করা হইয়াছে। ত্রিভুবন খুঁজিলেও একটা প্রাণী পাওয়া যায় না যে সর্বদাই সুখপ্রদ। পরমপ্রিয় বন্ধু পীড়িত হইয়া, অবশেষে মরিয়া, আমাকে জ্বালাতন করে। কার কাছে যাব বল ?

তৃতীয় তাপ—ঝড়, বাদল, বন্যা, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি আমাদের পিছনে লাগিয়াই আছে। শীত-গ্রীষ্মের জ্বালায় বারোমাস জ্বলিয়া মরি।

আধ্যাত্মিক (নিজের ভিতরের) তাপ, আধিভৌতিক (অন্যভূত বা জীবগণ কর্তৃক প্রদত্ত) ও আধিদৈবিক (দেবতাদের দ্বারা কৃত) তাপপূর্ণ এই জগৎ। যাবে কোথায় বাছাধন? কত চটিবে বলো? এই জগতে যেখানে যাবে, তোমার সুখ-দুঃখ আসিবেই আসিবে। নড়িয়া বসিলে, ক্ষণেকের আরাম মাত্র। পাশ ফিরিলে ক্ষণকাল সুখ বোধ হয়। তাই কর্তারা বলেন, “শ-ষ-স”, সয়ে থাকো, সয়ে থাকো, সয়ে থাকো।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

মানুষ মাত্রেরই একটা তথ্য জানা একান্ত কর্তব্য (দ্বিতীয় ভাগ)

২য় তাপ—মশা, মাছি, সর্প, ব্যাঘ্র, রোগের বীজাণু, চোর, ডাকাত, রাজা, অত্যাচারী শাসক, ‘বদরাগী-অহঙ্কারী-লোভী-সহবাসী’। কত বলিব, জগতের সকল জীবকে যেন আমায় দুঃখ দিবার জন্যই সৃষ্টি করা হইয়াছে। ত্রিভুবন খুঁজিলেও একটা প্রাণী পাওয়া যায় না যে সর্বদাই সুখপ্রদ। পরমপ্রিয় বন্ধু পীড়িত হইয়া, অবশেষে মরিয়া, আমাকে জ্বালাতন করে। কার কাছে যাব বল ?

তৃতীয় তাপ—ঝড়, বাদল, বন্যা, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি আমাদের পিছনে লাগিয়াই আছে। শীত-গ্রীষ্মের জ্বালায় বারোমাস জ্বলিয়া মরি।

আধ্যাত্মিক (নিজের ভিতরের) তাপ, আধিভৌতিক (অন্যভূত বা জীবগণ কর্তৃক প্রদত্ত) ও আধিদৈবিক (দেবতাদের দ্বারা কৃত) তাপপূর্ণ এই জগৎ। যাবে কোথায় বাছাধন? কত চটিবে বলো? এই জগতে যেখানে যাবে, তোমার সুখ-দুঃখ আসিবেই আসিবে। নড়িয়া বসিলে, ক্ষণেকের আরাম মাত্র। পাশ ফিরিলে ক্ষণকাল সুখ বোধ হয়। তাই কর্তারা বলেন, “শ-ষ-স”, সয়ে থাকো, সয়ে থাকো, সয়ে থাকো।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন হইতে :~
~~~~~~~~

জীবনের গোড়ায় সুখের আশা ৷ ঐটা গেলেই জীবন দীপের নির্বাণ ৷ কথাটা এখন ভারী লাগবে মনে হয়, কিন্তু উহা ঠিক বুঝতে আমার ৪০ বৎসর লাগিল ৷ এখনও মাঝে মাঝে সংশয় আসে ৷

জীবনের অনেকটাই অজানা, অনেকটাই ঢাকা ৷ শুধু জানাটুকুকে নিয়াই জীবনের সমস্যা মীমাংসা করিতে গিয়া আমরা পদে পদে ভুল করিয়া থাকি ৷

আত্মা তো নির্বিকার নিরিন্দ্রিয় ৷ তাঁহার হাত হইল কেন ? তিনি ধরিতে চান বলিয়া, ধরিতে না চাহিলে তাঁহার হাত থাকা না থাকা সমান নয় কি ?

এই দেহটাই ভোগের যন্ত্র ৷ তবে দেহ আছে বাসনা নাই, অর্থাৎ ‘খাই খাই’ করি না ৷ ইহার অর্থটা কি বল দেখি ? অতএব যতদিন দেহ আছে ততদিন খাওয়া চাই-ই চাই ৷

বৃথা ধর্ম, ত্যাগ, বৈরাগ্য, ঈশ্বর এসব বাজে কথা বলিয়া লাভ ? সুন্দরী স্ত্রী সম্ভোগ করিয়া তাহা যখন তিক্ত বোধ হয়, তখন মনে হয়, ‘বৃন্দাবনে বনে বনে ধেনু চরাব ৷’ অর্থাৎ আরও ভাল সম্ভোগের বস্তু চাই ৷ গোলোকে যাওয়া মানে আরও ঢের মজা চাওয়া আর কি ?

ভোগ ভোগ ! ভোগ ছাড়া কে যে কি চায় তা-তো বুঝি না ৷ তবে এক টাকার change এক পয়সা নয় — চৌষট্টি পয়সা ৷ গরিবের ভোগ ছেঁড়া কাঁথায়, বড়লোকের ভোগ পালকি গদিতে ৷ গ্রামের লোক গ্রাম্য ভোগে তৃপ্ত, জমিদার শহরে কলকাতায় ; রাজা-রাজড়া লন্ডনে প্যারী শহরে ৷ নটবর পাজা তার ফাঁদি-নথ-নাকে গিন্নি ঠাকুররাণীর চরণ ধ্যানে নিযুক্ত, জমিদার অপ্সরীতুলা সুষমা দেবীর প্রেমাসক্ত, নিত্যানন্দ বাবাজী শ্রীমতী রাধারানীর চরণে মন ঢালিয়াছেন ইত্যাদি ৷

ভাবিয়া দেখ সকলের এক object of love আছেন ৷ যাঁরা বড় তাঁরা ছোটটা ছাড়িয়া বড়টা ধরিয়াছেন মাত্র ৷ যারা বোকা তারা অল্পে সন্তুষ্ট, যারা খোকা তারা বাহ্য চাকচিক্যে ভুলে ৷ পাকা ধুরন্ধর লোক টেকসই জিনিস কিনে, খেলো জিনিস একেবারে চায় না ৷

কিন্তু একটি চাইত ! বড় হোক, ছোট হোক ! ভাল হোক, মন্দ হোক ৷ মাগী হোক, মরদ হোক ৷ একেবারে কিছু চাই না একথা কেহ বলে না ৷ অতএব সকলেই object pleasure চায় ? কি বল ?

‘কিছুই চাই না’ বলিতে পারে এমন লোক জগতে দুর্লভ ৷ এই জগতের সকল বস্তু চাখিয়া দেখিয়া সকল বস্তুতে তিক্তবুদ্ধি উপস্থিত হইলে তবে বলা যায় ‘আমি কিছুই চাই না ৷’ এই সব ব্যক্তিরা যেখানেই থাকুন সবই তাঁহাদের পক্ষে গুহা ৷ যাহাদের মনে চাই-চাই খাই-খাই কোনও না কোনও আকারে আছে তাহারা সকলেই সমান ৷

রাবণ কুম্ভকর্ণ বিভীষণ তিনজন একসঙ্গে যোগ অবলম্বনে রত হয় ৷ সকলেই মন নিরোধ করিয়াছিল ৷ রাবণ কুম্ভকর্ণের মন যদিও সাময়িকভাবে স্থির হইয়াছিল, কিন্তু ভিতরে ‘খাই-খাই’ ছিল, তাই ইষ্টদেব আসিয়া বর দিতে চাহিলে, ‘এই শরীরটা অমর’ করিয়া দিতে বলিল, দেখ কি আশ্চর্য ৷ কঠোর তপস্যা, গুহাবাস, বাহ্য সর্বত্যাগ প্রভৃতি দ্বারা মানুষের মন বুঝা যায় না ৷ কেহ কিছু সোজা মনের কথা বলিতে পারে না, কেহ বুদ্ধিমান মনের ভাব চাপিয়া কার্য হাসিল করিতে পারে ৷ আজকাল ইহাকেই ‘সইব্য’ বলে ৷

পশুর মত কাজ কর — কথাবার্তায় প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে, বেশ, তুমি একটি ‘সইব্য’ আদমী ৷ কিন্তু ভগবান মানুষের মন দেখেন, তাঁকে তো কেহ ভুলাতে পারে না ৷ তাঁর দৃষ্টিতে কে সভ্য, কে অসভ্য, কে বলিতে পারে ?

Swami Premeshanandaji’s collection

প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় করাইবার জন্য ঠাকুর তোমায় একটু ঘুরাইতেছেন।

তুমি শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে যাদের মন আকৃষ্ট করিতেছ তাদের আত্মা তোমাকে কত আশীর্বাদ করে তাহা কি বলিব। তাঁর নাম প্রচার করার মতো মহৎ কাজ আর নাই। শাস্ত্রে উহার বহু প্রশংসা আছে।

তুমি যদি শরীর ভালো রাখিতে পারো, যদি ব্রহ্মচর্য রক্ষা করিয়া চলিতে পারো তবে যে দিন বসিবে সেদিনই তাঁকে পাইবে। তুমি তাঁকে যত ভালবাসো তিনি তোমাকে তার চেয়ে ঢের বেশি ভালোবাসেন গো। এই বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই।

‘রামকৃষ্ণ সাহিত্য’ একটি বিরাট সাহিত্য। শুধু পড়িয়া পড়িয়া এক জীবন কাটাইয়া দেওয়া যায়।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Yatiswaranandaji s spiritual Msj

শুদ্ধমনইগুরুরকাজকরে

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন, ‘তোমার মনের থেকে আরো বড় কোন গুরু নেই ৷’

মানুষ গুরু সব সময়ে কাছে থাকেন না ৷ যথেষ্ট ভাগ্যের জোরে যদিও তুমি কোন উন্নত আচার্যের আশীর্বাদ ও উপদেশ পাও, তবুও সব সময়ে তোমার প্রয়োজনে তাঁকে নাও পেতে পার ৷ কিন্তু একজন অন্তরের আচার্য আছেন, যিনি শুদ্ধ মনরূপে সদা আমাদের অন্তরে বিরাজ করছেন ৷

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেন, ‘যখন প্রার্থনা ও ধ্যানের সহায়তায় মন শুদ্ধ হয়ে ওঠে, সেই মনই অন্তর থেকে তোমাকে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাবে ৷ এমনকি তোমার দৈনন্দিন কাজে এই আন্তর গুরু তোমাকে পথ দেখাবে ও তোমাকে সাহায্য করবে যতদিন না লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছ ৷’

মন কিভাবে আন্তর গুরুর কাজ করবে ?

সমস্ত জ্ঞানের আকর, সকল আচার্যের আচার্য, পরমাত্মা যে সদা প্রতি হৃদয়ে বর্তমান রয়েছেন ৷ নৈতিক জীবন, প্রার্থনা, ধ্যান প্রভৃতির মাধ্যমে যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন সেই মন পরমাত্মার অন্তর্জ্যোতির সংস্পর্শে আসে ৷ এই শুদ্ধ মনই তখন দৈব চেতনা প্রবাহের এক প্রণালী হয়ে ওঠে ৷ মন, আচার্যের আচার্য যিনি, তাঁর কাছ থেকে সরাসরি আধ্যাত্মিক নির্দেশনা লাভ করে ৷ মন যখন এইভাবে অন্তরের সত্যের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করতে শেখে, সে তখন নানা উৎস থেকে উপদেশ পেতে পারে ৷

কিন্তু আমাদের সাবধান থাকতে হবে, পাছে নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে বসি ৷ আমরা মনে করতে পারি যে আমাদের মন উত্তম গুরুর পর্যায়ে উঠেছে ৷ আমরা সর্বত্র আদেশ পাচ্ছি ৷ কিন্তু আমাদের নিজেদের বাসনা ও চিন্তাকে ঈশ্বরীয় প্রেরণা, ঈশ্বরের বাণী ইত্যাদি বলে ভুল করার বিপদ সব সময়েই রয়েছে ৷ এ বিপদ থাকে না যদি আমরা আদেশ পাই একজন জীবিত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন আচার্যের কাছ থেকে এবং তাঁর দ্বারাই চালিত হই ৷

মানুষ গুরু শিষ্যকে নৈতিক সংযম ও অনাসক্তভাবে কাজ করার অভ্যাসের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি বিধান করতে আদেশ দেন ৷ শিষ্য ভুল করলে, গুরু তা লক্ষ্য করে তাকে আবার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনেন ৷ একজন উপযুক্ত মানুষ গুরুর নির্দেশ পাবার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা বিপথে যায় না ৷ ধীরে ধীরে গুরুর আশীর্বাদে শিষ্যের সজ্ঞার উন্মেষ হয় এবং তখন থেকে তার শুদ্ধ স্বতঃলব্ধ জ্ঞান গুরুর কাজ করে ৷ এই ভাবে নিজ মনই গুরু হয়ে যায় ৷

                                      — স্বামী যতীশ্বরানন্দ ৷

Swami Premeshanandaji’s collection

তুমি উপার্জনের চেষ্টা করিতেছ জানিয়া সুখী হইলাম।

শরীর বলিতে দেহ মন বুদ্ধি বুঝায়। বুদ্ধি যখন নিষ্ক্রিয় হয় তখন নিদ্রা বলে। বুদ্ধিই মায়া, বুদ্ধিই অজ্ঞান। বুদ্ধি হইতেই জগতের সৃষ্টি—বুদ্ধি মনের সাহায্যে জগতকে জানে। মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নেয়। আবার ইন্দ্রিয় বাহিরের ইন্দ্রিয়গোলকের দ্বারা বিষয় গ্রহণ করে। ধ্যানের দ্বারা শরীর নামক যন্ত্রের mechanism না বুঝিলে, শুনিয়া কোনও লাভ নাই। প্রবল ইচ্ছা শক্তি দ্বারা মনকে জোরে প্রত্যাহৃত করা প্রয়োজন। স্বামীজীর রাজ যোগ পড়ো।

—- স্বামী প্রেমেশানন্দ

Swami Premeshanandaji’s collection

“এই জগতে অনন্ত relative truth আছে। কিন্তু absolute truth একটি। তা আমার real life । তাকে জানলে আর কিছু জানবার প্রয়োজন হয় না।”
——এরকমই নানান শিক্ষনীয় বিষয়ে স্বামী প্রেমেশানন্দজী মহারাজ ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ তারিখে এক চিঠিতে স্বামী স্বাহানন্দজীকে লিখছেন……..

…. আমি তোমাকে যা লিখি তা আপন খেয়ালেই লিখি। তুমি কোনও প্রসঙ্গ উত্থাপন কর না, কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর না তার ফলে আমি কি লিখেছি মনে থাকে না। এক কথাই হয়তো বার বার লিখছি অথচ কাজের কথা অনেকই বলতে বাকি রয়ে গেল। অবশ্য আমার বক্তব্য খুব অল্প। এক কথায় ‘রামকৃষ্ণ ভজ’ বললেই আমার সব কথা ফুরায়। আবার প্রশ্ন ওঠে ‘রামকৃষ্ণ কে ও কি?’ তখন কথায় কথা বাড়ে।

এই জগতে অনন্ত relative truth আছে। কিন্তু absolute truth একটি। তা আমার real life । তাকে জানলে আর কিছু জানবার প্রয়োজন হয় না। তা জানবার উপায়, আমি ছাড়া অন্য বস্তু সম্বন্ধে বৈরাগ্য। এই কথাটাই সকল কথার শেষ কথা। যারা মুক্তি চায় তাদের আর অন্য কিছু জানবার প্রয়োজন নেই। আর ঐ জ্ঞান লাভ করবার পথও সোজা — আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ।’

কিন্তু আমরা জগৎ হতে বের হয়ে যাবার পথে অন্যান্য পথিকদেরকেও এই মুক্তির বার্তা দিয়ে যেতে চাই। আমাদের উপর আদেশ — “আত্মনঃ মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ — সাধনা করতে হইবে। আমাদের শুধু নিজের আত্মার সন্ধান করলে চলবে না। সকলকে আত্মার সন্ধান দিতে হবে। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, ‘যে নিজেকে মারতে চায় তার একটা নরুন হলেই চলে। আর যে অপরকে মারতে চায় তার ঢাল তলোয়ার দরকার।’ তলোয়ার ঠাকুর স্বামীজীর শিক্ষা, আর ঢাল আমাদের নিজের বিদ্যা। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও সাধনা দিয়ে আত্মরক্ষা করে ঠাকুর স্বামীজীর শিক্ষারূপ অস্ত্র প্রয়োগে জগতের অজ্ঞান অসুরকে আমরা সংহার করব। আমরা ঠাকুরের সৈন্য, তাঁর কাজ করে সম্মুখ সমরে মরতে পারলে ‘স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্’ সামনে আছে। তিনি নিজ এসেছেন, আমাদের আর জয় পরাজয়ের ভাবনা নেই। এই তুচ্ছ দেহমন তাঁর কাজে লাগিয়ে আমরা অমৃতত্ব লাভ করব — কাঁচের বদলে কাঞ্চন নেব। শ্রীশ্রীঠাকুরের সেই ‘ন-সের বেগুনের ‘ গল্প মনে কর। এবার যে সত্যসত্যই ‘ন-সের বেগুন ‘ দিয়ে আমরা হীরে জহরৎ লাভ করবার আশা করি।

কিন্তু হীরে-জহরতের প্রয়োজন বোধ হওয়া সুকঠিন। বস্তুতই হীরে-জহরত আমরা চাই না। দেখা যাচ্ছে এমন ঠাকুর এসেছেন তাঁকে কেউ চায় না। পনের বছর শ্রীহট্টে ছিলাম। নানা স্থানে ঘুরে তাঁর আগমন বার্তা প্রচারের চেষ্টা করেছি — দু-চার জন ছাড়া কেউ কানে তোলে নি। এদেশে গত দুবছর অনেক হ্যাঙ্গাম করলাম, জিনিস নেড়ে-চেড়ে অনাবশ্যক মনে করে ফেলে যায় — কেউ কিনতে চায় না। সবই কড়ায়ের ডালের খদ্দের — দামি জিনিস কেউ নিতে চায় না। বিনামূল্যে দিলেও না। বাড়িতে নিলে যে একটু জায়গা দরকার তা ছাড়তেও রাজি না। আজকাল আমাদের অনেক ঐশ্বর্য হয়েছে। তাই রাজসিক লোক কেউ কেউ মোহান্ত মহারাজের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছে। Spirituality-র জন্য নয়। বড়লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা করবার জন্য। আবার বড় লোক যাতায়াত করে দেখে এবং বেলুড় মঠের মন্দির দেখে — জমিদার রামকৃষ্ণের খোসামোদ কেউ কেউ করে বটে, কিন্তু তাও বেশি দিন চলে না। কিছুদিন বাদে সমস্ত পানসে মনে হয়।

এক জমিদার বাড়িতে কতকগুলো সুন্দর সুন্দর চীনেমাটির বাসন আনা হয়। তা দেখে উপস্থিত সবাই খুব আনন্দ প্রকাশ করে। সেখানে এক ব্যাটা চাকর হাজির ছিল। তার মনে হলো জিনিসটা তাহলে বোধ হয় খুব ভালো। সে সুযোগ মতো একটা চুরি করে বাড়ি নিয়ে রাখলো। বাড়িতে ওটার কি ব্যবহার হতে পারে? তার স্ত্রী ওটাতে শুটকী ঝোল খায়। এখন হঠাৎ একদিন তার ছোট ছেলে সেটাকে ভেঙ্গে ফেলল এবং তার ভাঙ্গা ধার অংশ লেগে ছেলের হাত কেটে গেল। চাকর বাড়ি আসলে তার স্ত্রী এই অনিষ্টকারী জিনিস বাড়ি এনেছিল বলে গালাগাল দিল।

শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে লোকে সেইরকম করছে। কথামৃত পড়লে জানবে, স্বামীজীরা পর্যন্ত তাঁকে প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট দিয়েছেন।

তুমি কি ঠাকুরকে চাও? বুঝলে চাওয়ার সুবিধে হয় বটে — কিন্তু বোঝাই চাওয়া নয়। চাইতে হলে চাওয়া অভ্যাস করতে হয়।

‘অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে।’ ……

–স্বামী প্রেমেশানন্দ

(*) লেখাটি এখানে কথ্য ভাষায় পাল্টে নিয়ে পরিবেশিত হল।)

Design a site like this with WordPress.com
Get started